সব চরিত্র কাল্পনিক নয় (৫)

Posted by

পর্ব – ৫ 

জানা অজানায় 

সময়টা ১৯৮৪, জুলাই মাস। আকাশ কালো করে অন্ধকার নেমে আসা শহরে সেদিন সাতসকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি। শহর কলকাতা সেই বাঁধভাঙ্গা বর্ষণে দিশাহারা। অলিগলি রাজপথ একাকার হয়ে মিলেমিশে যাচ্ছে সেই প্লাবনে। প্রচণ্ড দুর্যোগের আশঙ্কায় স্থাবরজঙ্গম স্থির। তবে কি আবার সেই ছ-বছর আগের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? ১৯৭৮এর ভয়ানক বন্যার স্মৃতি কলকাতার মননে তখনো তাজা। এবার বোধহয় আরো মারাত্মক কিছু হতে চলেছে।

মা সেদিন মিঠুনকে স্কুলে পাঠায়নি ইচ্ছে করেই। কিন্তু আমার তখন ক্লাস সেভেন, কথায় কথায় স্কুল কামাই করলে মুশকিল, আর তাছাড়া একটু স্বাবলম্বী (-বলা ভালো স্বাধীন-) হওয়ার বাড়তি সুড়সুড়িও মগজে অনুভূত। তাই স্কুলবাসে চেপে কোনরকমে স্কুলে পৌঁছলেও রেইনি-ডে ঘোষিত, এবং আমি বেশ একটা ফাঁকতালে পাওয়া ছুটি এবং এই অযাচিত অনিশ্চয়তা ও রোমাঞ্চের যুগলবন্দিতে যারপরনাই উল্লসিত। কিন্তু তার কিছুক্ষনের মধ্যেই টের পেলাম যে বাড়ি ফেরাটা এবার কতটা কঠিন হতে চলেছে। স্কুলবাসে ফেরা হবে না, সেটা আজ আর এমুখো হবে না ধরে নেওয়া যায়। স্কুলের সামনে একহাঁটু জল তখনই, বৃষ্টি থামার কোন নামগন্ধ নেই। কোনরকমে মৌলালীর মোড় অবধি জল ঠেলে আসা গেছে, কিন্তু বৃষ্টির তোড়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। আবছাভাবে দেখলাম একটা বাস এসে দাঁড়ালো সামনে, একজন যাত্রী কোনরকমে ছাতা খুলে ঝপাং করে নেমে পড়লেন হাঁটুজলে, আর আমি জয়-মা বলে হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে পড়লাম পাদানিতে।

কনডাকটার-কাকু যতক্ষণে আমাকে টান মেরে তুলে এবং ঠেলে ভেতরে চালান করেছে, ততক্ষণে আমি একটা ছোট্ট অঙ্ক করে ফেলেছি মনে মনে। এই বাসটা দত্তবাগান যাবে না, এটা পাল্টে শ্যামবাজারে নেমে আরেকটা বাস ধরে বাড়ি ফেরা এই পরিস্থিতিতে প্রায় অসম্ভব। সুতরাং, সুকিয়া স্ট্রিট এলে নেমে পড়তে হবে (অবশ্য যদি শেষমেশ ওটুকুও বাসটা যায়)। তারপর, এককোমর (বা একগলা) জল ভেঙে যেভাবেই হোক পৌঁছতে পারলে হরিনাথ দে রোডের সি-আই-টি বিল্ডিং, ব্যাস। মামারবাড়ি।

হ্যাঁ, সত্যিই মামারবাড়ি ছাড়া সেদিন আর কোন উপায় ছিল না। ওটা এমনিতেই ছিল আমার দ্বিতীয় আস্তানা, দুবার ভাবিনি সেদিন আর কিছু।

আমার দুই মামা বরাবরই কমপ্লিমেনটারি। সক্কালবেলায় আনন্দবাজার আসার সময় হলে দুজনেই সজাগ থাকতো, কিন্তু শেষমেশ কাগজটা ভাগাভাগি করেই পড়তো। যে আগে প্রথম পাতাটা নিতে পারবে, সে ভালো খবরগুলো তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলে চা শেষ করে বাথরুমে ঢুকে পড়বে। দুজনেই প্রায় একসাথে অফিসে বেরোতো বাড়ি থেকে, ভাত-টাত খেয়ে পান মুখে দিয়ে। একজন যেত সল্টলেকে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে, আরেকজন থিয়েটার রোডে (-পরে ঢাকুরিয়ায়-) ইন্ডিয়ান অয়েল-এর অফিসে। ফিরতো দুজনেই প্রায় একই সময়ে, সন্ধ্যের দিকে। ফিরে লুঙ্গী আর হাতাওলা গেঞ্জি পরে বাইরের ঘরের খাটটাতে উঠে জায়গার দখল নিত। টিভি চালু হতো, তখন দূরদর্শনের যুগ। তবে তার সঙ্গে ফাউ ছিল বাংলাদেশের কিছু চ্যানেল, যেগুলো ধরতে গেলে একটা বাড়তি অ্যান্টেনার দরকার হতো। সেটার ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু সেটাকে “ফাইন- টিউন” করতে হতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, ঠিক ডাইরেকশান-এ। তাই একজন যেত ছাতে, গিয়ে অ্যান্টেনা ঘোরাতো, আর নিচের দিকে উদ্দেশ্য করে বলতো, “এলো?” আরেকজন নিচ থেকে ছাতের দিকে তাকিয়ে বলতো, “আসেনি” বা “এসেছে, এসেছে!” এটা মাঝে মাঝেই করতে হতো, কারণ সিগনাল কোয়ালিটি বিশেষ ভালো কিছু ছিল না সে যুগে। ভাগ্যিস ফ্ল্যাটবাড়িটা চারতলা ছিল আর এই কথোপকথনটা সীমাবদ্ধ থাকতো চারতলার ফ্ল্যাট আর ছাতের মধ্যে, তাই ব্যাপারটা ম্যানেজ হয়ে যেত কোনোভাবে। সেসময় বেশ ভালো ভালো কিছু টিভি সিরিজ দেখাতো বাংলাদেশ টিভিতে, যেমন “The Six Million Dollar Man”, “Bionic Woman” বা “Knight Rider” – মামারবাড়িতে মাঝে মধ্যেই ঘাঁটি গাড়ার একটা প্রধান কারণ ছিল সেগুলো দেখা।

মামাদের বন্ধুরাও কমন তারাও বেশ ইনটারেসটিং গোছের, আমাকে “কি ভাগ্নে …” বলে হাল্কা খবরাখবর নিত তাদের আড্ডাতেও মাঝেমধ্যে ঢুকে পড়েছি, পরবর্তীকালে দেখেছি সি-আই-টি বিল্ডিং-এর রকে বসে আড্ডা জমে উঠতে দুই মামা ছিল সেই রক-এ একদম কমপালসরি অ্যাটেনডী মাঝে মধ্যে আমি যখন একটু সন্ধ্যে করে সি-আই-টি বিল্ডিং-এ ঢুকছি, তখন দেখেছি রকে দুই মামা ছাড়া সেদিন আর কেউ বিশেষ উপস্থিত নেই তবে এই দুজন দুদিকে মুখ করে ঠিকই বসে আছে

জল ভেঙে বৃষ্টি মাথায় করে কোনরকমে তো পৌঁছলাম সি-আই-টি বিল্ডিং। দেখলাম মামারাও সেদিন রেইনি-ডে পালনরত। আমার কাছ থেকে বাইরের রাস্তাঘাটের অবস্থা, কতটা জল জমেছে, দোকানবাজার খোলা না বন্ধ ইত্যাদির লাইভ আপডেট নিলো দুজনেই। বেশ বোঝা গেল, ব্যাপারটা সিরিয়াস হতে চলেছে। এই পুরো জায়গাটা, মানে হরিনাথ দে রোড – রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট – রামমোহন রায় রোড – সুকিয়া স্ট্রীট অঞ্চলটা বিখ্যাত ছিল বর্ষাকালে জল জমার ব্যাপারে। সেরকম হলে সুকিয়া স্ট্রীটে নৌকোও নামাতে হতো। আর এককোমর বা একবুক জল তো আকছারই জমতো। সেদিন তখনই প্রায় এককোমর জল ভেঙে ঢুকেছি হরিনাথ দে রোড দিয়ে, আর বৃষ্টি তখনো তুমুল চলছে। কিন্তু এটাই শেষ নয়, এর ওপর প্রত্যাশিতভাবেই কারেন্টও চলে গেলো।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও বৃষ্টি থামেনি। তার আগে দুপুরবেলায় খিচুড়ি খেয়ে টোয়েনটি-নাইন খেলা হয়েছে একপ্রস্থ। অন্ধকার আকাশ বিকেল আর সন্ধ্যের ফারাক বুঝতে দেয়নি, তাই জানলার গরাদে মুখ রেখে বৃষ্টির গতিপ্রকৃতি দেখতে দেখতেই রাত নেমে এলো। মোমবাতি আর হ্যারিকেনের আলোর চারপাশে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে চেপে বসছিলো। রেডিওতে খবর বলছে কলকাতা শহর প্রায় সর্বাংশে জলমগ্ন, বিদ্যুৎবিহীন এবং অচল। আগামীদিনের পূর্বাভাস বলছে ভারী থেকে মধ্যম প্রকৃতির বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। অতএব, রান্নাঘরের দিকটা আর মোমবাতির স্টকটা একবার দেখে রাখা আশু প্রয়োজন।

বোধহয় রাত নটা-দশটা নাগাদ বৃষ্টিটা থামলো। ছাতে উঠলাম সবাই মিলে। আমরা একা নই, ততক্ষণে বেশীরভাগ ফ্ল্যাটের বাসিন্দারাই ছাতে হাজির। ঐ অন্ধকারেও সোশ্যাল নেটওয়ারকিং জমে উঠতে দেরী হয়নি। ছাতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টর্চের আলো নীচে গিয়ে পড়ছে জমা জলের ওপর, বেশ বোঝা যাচ্ছে যে একতলার ফ্ল্যাটগুলো প্রায় ডুবন্ত, জানলা ছাপিয়ে জল ঢুকেছে ঘরে। একগলা জল তো হবেই।

সারারাত কারেন্ট আসেনি, কিন্তু বৃষ্টির দৌলতে ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডাই ছিল। পরদিন সকালে চা খেয়েই দুই মামা এবং আমি আবার ছাতে। সেখানেই খবর পাওয়া গেল যে মানিকতলা বাজার বসেছে, তবে হাতেগোনা কিছু স্টল। সেখানে পৌঁছতে গেলে সাঁতরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, কারণ হরিনাথ দে রোড – রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট পুরোপুরি জলের তলায়। সাঁতার জানে একমাত্র ছোটমামা, হেদুয়াতে শিখেছিলো বিয়ের আগে। তারপর পুরী-দীঘা ইত্যাদি সমুদ্রে আমাদের একটু ডেমোও দিয়েছে। তাই পাজামা আর গেঞ্জি পরে ঐ জমা জল ভেঙে (-বা সাঁতরে-) ছোটমামা চললো বাজারে, আর বেশ কিছুক্ষণ পর থলিতে করে আলু-পেঁয়াজ–ডিম ইত্যাদি নিয়ে ফেরত এলো, অনেকটা যুদ্ধজয়ের ভঙ্গিমায়। 

ছোটমামা অনেকটাই চনমনে, ইয়ার্কিপ্রিয়, মিশুকে প্রকৃতির। বড়মামা গম্ভীর, এদিকওদিক হলেই ধমকধামক দিয়ে থাকে। যেকোনো সিরিয়াস আলোচনা বড়মামা শুরু করলে ছোটমামা একটা ফোড়ন কাটবেই। আমার যখন একটু একটু গোঁফদাড়ি গজানো শুরু হয়েছিলো, তখন একটা বিশেষ আকর্ষক আলোচনা ছিল আমি আমার কাকাদের মতো লম্বা হবো, না মামাদের মতো নাতিদীর্ঘ। ছোটমামা এই আলোচনায় একেবারে জল ঢেলে দিয়েছিলো আমার মাথায় হাত ছুঁইয়ে, “যা, আশীর্বাদ করে দিলাম এখানেই আটকে যাবি”। তখন আমি পাঁচ-ফুট সাড়ে-পাঁচ ইঞ্চি, সত্যিই আর তার বাইরে বেরোতে পারিনি। 

পাড়ায় ফুটবল খেলার পর আমাদের অবশ্য কর্তব্য ছিল পাশের পুকুরে নেমে সাঁতার শেখার প্র্যাকটিস করা। অপুদা, বিজনদা ইত্যাদি দাদারা আমাদের সাঁতার শেখানোর দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছিলো, এবং জলে নেমে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে  বেশ কয়েকজন সাঁতার শিখেও গেল, আমি ছাড়া। এমনই একদিন বিকেলের দিকে ছোটমামা আমাদের বাড়ি এসেছিলো, এবং ফেরার সময় পুকুরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমায় সাঁতার শেখার চেষ্টায় রত দেখে পরে সবাইকে বলেছিলো, “তোতন কে দেখলাম ওই পানাপুকুরটাতে হাঁটুজলে খাবি খাচ্ছিলো”। এরপর যারপরনাই খোরাক হয়েও আমি পুকুরে নামা বন্ধ করিনি, কারণ বিশ্বাস ছিল এভাবেই ঠিক শিখে যাবো।

তবে এই বিশ্বাস যে কতটা ভ্রান্ত, এবং কি সাংঘাতিকভাবে বিপদজনক, তার প্রমান পেলাম খুব শীগগিরই।

মহালয়া। এই দিনটা বাবা চলে যাওয়ার পর আরও বিশেষ হয়ে উঠেছিলো। মামাদের সাথে আমিও গঙ্গায় তর্পণ করতে যেতাম ওইদিনে। আগের দিনই মামারবাড়ি চলে যেতাম। মহালয়ার দিন খুব ভোরে আমাদের তিনজনকে ঘুম থেকে তুলে একটু মিষ্টি কিছু খাইয়ে দিতো মামীমারা। তারপর আধোঘুমে রেডিও থেকে ভেসে আসা মহিষাসুরমর্দিনী শুনতে শুনতে দিনটা শুরু হতো। সকাল সকাল নিমতলা ঘাটে হাজির হতাম আমরা তিনজন, দুই মামা আর ভাগ্নে। একজন চেনা গোছের পুরুতমশাই ছিলেন, আমাদের কাজ তিনিই করাতেন। সব মিটে গেলে ফেরার পথে একটা মিষ্টির দোকানে কচুরি আর ছোলার ডাল দিয়ে জম্পেশ একটা ব্রেকফাস্ট সেরে বাড়ি ফেরা।

কিন্তু সেবার একটু অন্যরকম হয়ে গেলো সবকিছু। যথারীতি ঘাটে এসে জামাপ্যান্ট ছেড়ে ধুতি পরে নিয়েছি, সাথে গায়ে একটা গামছা। দুটো ডুব দিয়ে এসে তর্পণ ভালোভাবেই সারা হয়েছে। পুরুতমশাই নেক্সট কাস্টমারের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। বড়মামা ঘাটের দুটো ধাপ নেমে হাঁটুজলে বাকি স্নান সারার চেষ্টা করছে, সাঁতার জানেনা আর জলে একটু ভয়ও আছে, বেশি নামে না আর আমাদেরও নামতে দেয় না। ছোটমামা কিন্তু একটা ছোট্ট ডাইভ মেরে একটু ভেতরে চলে গেছে, আর ডেমো দিচ্ছে সাঁতারের। আমার কি হলো কে জানে, আমিও পাড়ার পুকুরের সাঁতারের স্কিল দেখাতে গিয়ে জলের গভীরে দিলাম একটা ঝাঁপ।

আজও স্পষ্ট মনে আছে, ঝাঁপটা দিয়েই বুঝলাম বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি, কারণ পুকুরে হাত-পা ছোঁড়া এক ব্যাপার আর ভরা গঙ্গার স্রোতে সাঁতার কাটা আরেক। স্রোতটা আমাকে আরও সরিয়ে নিয়ে গেলো ঘাটের দিকে থেকে, আর আমি টের পেলাম যে পায়ের তলায় আর ঘাটের সিঁড়ি নেই। কমপ্লিট প্যানিক তখন। হাত-পা ছুঁড়ছি কিন্তু ভেসে উঠতে পারছি না।

ছোটমামা কাছেই ছিল, আর আমার হাল দেখে ভেসে এসেছে আমার পাশে, আর সেটাই ভুল হলো, কারণ কথায় বলে ডুবন্ত মানুষকে বাঁচাতে গেলে কখনো কাছে যেতে নেই। আমি জাপটে ধরলাম ছোটমামাকে, আর তার ফলে ছোটমামাও জড়িয়ে গেলো আমার সাথে। দুজনেই ডুবতে ডুবতে আর ভাসতে ভাসতে গঙ্গার পাড় থেকে আরও দূরে সরে যেতে লাগলাম ক্রমশ।

তারপর ঠিক কি হয়েছিলো আমার পরিস্কার মনে নেই, কিন্তু আরেকজন পুরো ব্যাপারটা অসহায়ের মতো দেখছিলো। বড়মামার ভার্সান অনুযায়ী, একজনও এগিয়ে আসেনি আমাদের বাঁচাতে, অথচ ঘাটভর্তি লোক সেদিন, তার মধ্যে বেশ কিছু লোক (-আমাদের পুরুতমশাই সমেত-) নিশ্চয়ই সাঁতার জানা। দুজন ডুবন্ত লোককে বাঁচানোর ঝুঁকি কেই বা নেবে, আর কেনই বা নেবে। বড়মামা নেমে এসেছিলো গলাজল অবধি, আর হাতের গামছাটা দড়ির মতো ছুঁড়ে দিয়েছিলো আমাদের দিকে। নেহাতই ভাগ্যবলে ছোটমামার হাত পড়েছিলো গামছাটায়, সেটা কোনরকমে ধরতেই বড়মামা টেনে নিয়েছিলো ঘাটের দিকে।

কোলাহল সব মিটলে আমরা তিনজন যখন একটু একা হলাম, ভেবেছিলাম আর মুখ তুলে তাকাতে পারবো না দুজনের দিকে, বিশেষ করে ছোটমামার দিকে। কিন্তু আমাকে একটা বকুনিও দেয়নি সেদিন একজনও। শুধু বড়মামা বলেছিলো, এই ঘটনাটা কাউকে জানানো চলবে না। কাউকে না। কেউ জানতোও না বহুদিন, বহু বছর। শুধু প্রতিবার তর্পণের সময় সেই পুরুতমশাই আমাদের দেখামাত্র আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, “কি খেল দেখিয়েছিলে বাবা!” আর ছোটমামা বলতো, “তোতন সাবধান কিন্তু!”

বহুবার পরে ভেবেছি, এতবড় নির্বোধের মতো কাজ কি করে করেছিলাম সেদিন। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম, কি ভীষণ পরিণত ভাবে ঘটনাটা সামলেছিলো আমার দুই মামা। ওই ঘটনাটা ভুলে যাওয়ার সবথেকে ভালো উপায় ছিল ঘটনাটা বেমালুম চেপে যাওয়া। নিজেদের মধ্যে বহুবার কথা হয়েছে ওই দিনটা নিয়ে, কিন্তু শেষমেশ হেসে উড়িয়ে দিয়েছি ব্যাপারটা তিনজনেই।

আজ সেই ঘটনাটা নিয়ে কথা বলার লোক একজন কমে গেছে। অকস্মাৎ, সবাইকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে, ছোটমামা চলে গেছে প্রায় বছর দুয়েক আগে। তারপর আর মামারবাড়ি যাওয়া হয়নি আমার।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s