পালকের দস্তানা

Posted by

১৯৮৩, ২৫শে জুন সেই লর্ডস যখন সন্দীপ পাটিল আউট হলেন ২৭ রান করে, ভারত তখন ধুঁকছে ১৫৩ রানে। দশ নম্বরে ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন কিরমানি। ক্রিজে অন্যদিকে মদনলাল, তিনিও আরো আট রানের মাথায় মার্শালের বলে বোল্ড। এলেন বলবিন্দার সিং সান্ধু, ভারতের এযাবৎ শ্রেষ্ঠ এগারো নম্বর ব্যাটসম্যান, এসেই হোল্ডিংকে কেতাবি কভার ড্রাইভ মারলেন একখানা। মার্শালের বাউন্সার আছড়ে পড়েছিলো সান্ধুর হেলমেটে তার পরের ওভারেই। সে যাই হোক, আজকের গল্প সান্ধুকে নিয়ে নয়। নাছোড়বান্দা কিরমানিনাইটওয়াচম্যান কিরমানি বলে তাঁকে ডাকা শুরু করেছিলেন ধারাভাষ্যকাররাশেষমেশ যখন হোল্ডিংএর বলে বোল্ড হলেন, ভারত তখন ১৮৩।

কাট- ২। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস চলছে, একটু নড়বড়ে লাগছে বটে কিন্তু দুজোঁ যে মেজাজে ব্যাট করছেন তাতে মনে হচ্ছে আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। সঙ্গী ফাউদ ব্যাকাস। ঠিক তখনই বোলিং চেঞ্জ করে কপিল ডাকলেন সেই সান্ধুকে, যাঁর ইনসুইংগার শোলডার-আর্ম করে বোল্ড হয়ে সকাল-সকাল প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন গ্রীনিজ । সান্ধু এলেন, এবার আউটসুইংগার, অফস্টাম্পের বেশ বাইরে। ব্যাকাস এতক্ষণ ঠুকঠাক করছিলেন, আর লোভ সামলাতে পারলেন না, ড্রাইভ মারতে গেলেন, ব্যাটের বাইরের কোনায় লেগে বল যাচ্ছে ফার্স্ট স্লিপের দিকে, কিন্তু অতটা ক্যারি করবে না। ঠিক তখনই, ফ্রেমের মধ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন, মানে গড়িয়ে গেলেন – কিরমানি। তালুবন্দি ব্যাকাস, মাচের শ্রেষ্ঠ ক্যাচ।

এরপর বহুদিন ধরে বহুবার চর্চিত হয়েছে কপিলের সেই বিখ্যাত ক্যাচ, যা কিনা রোডরোলারের মতো চলতে থাকা রিচার্ডস-কে ফিরিয়ে দিয়ে ভারতের জয়ের রাস্তা খুলে দিয়েছিল। তবে কপিল নিজে বলেছেন, মাচের আসল গেম চেঞ্জার ছিল সান্ধুর সেই ইনসুইংগার, যা কিনা অল্প হলেও আশা দেখাতে পেরেছিল যে ১৮৩ করেও কাপ জেতা সম্ভব, ফিরিয়ে এনেছিল হারাতে বসা আত্মবিশ্বাস। তবে এরই মধ্যে প্রায় নিরুচ্চারিতই রয়ে গেছে সেই তিরিশ রানের পার্টনারশিপ দুটো, এবং সেই ক্যাচ। ঠিক তেমনই, সেভাবে আর মনে পড়বে না জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে কপিলের ১৭৫ রানের সেই ইনিংসের সঙ্গে মিশে থাকা কিরমানির ২৪ নট আউট এবং পাঁচটা ক্যাচ।

কিরমানি এইরকমই। রৌদ্রজ্জ্বল নন ঠিকই, কিন্তু ছায়া ধরে রেখেছেন বরাবর। ছায়াটা না থাকলে চারাগাছটা এতটা বাড়তে পারতো কি?

ষাটের দশকের গোড়ার দিক। আদতে চেন্নাইএর বাসিন্দা এই পরিবারটি কিছু বছর হল উঠে এসেছেন বেঙ্গালুরুতে, হায়দ্রাবাদ থেকে। বাড়ির ছোট ছেলেটি ঠিক মিশে গেছিলো পাড়ার বাকি ছেলেদের সঙ্গে, যদিও বয়েসে সে সবচেয়ে ছোট। সেবার ঠিক হল যে একটা ক্রিকেট টীম হবে। টীমের লিডার ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিল উইকেটের পিছনে, পানিশমেন্ট পোস্টিং। এদিকে কর্ক বল দিয়ে খেলা, ধরার জন্য গ্লাভস কোথায়? ছেলেটি এদিক ওদিক তাকিয়ে দুটো ইটের টুকরো তুলে নিল। এদুটো দিয়ে অন্তত বল আটকানো তো যাবে! এই পাথরের দস্তানা হাতে মাঠে নামলেন সইয়দ মুজতবা হুসেইন কিরমানি, আর অজান্তেই এই দস্তানা বদলে গেল নরম পালকের মতো আস্তরণে, হয়ে উঠলো পরম নির্ভরযোগ্য এবং আরামদায়ক। হঠাৎ করেই জন্ম হল ভারতের শ্রেষ্ঠ দস্তানাবাজের।

মজার ব্যাপার হল, অনেকটা এম এস ধোনির মতই, কিরমানি একেবারে গোড়ার দিকে উইকেটকীপার কম ব্যাটসম্যান বেশি ছিলেন। ষোল বছর বয়েসে ডেব্যু করেন স্কুল ক্রিকেটে, কুচবিহার ট্রফিতে, কীপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে। তারপর ভারতের স্কুল টেস্ট টীমে চান্স পান, আর সঙ্গে সঙ্গেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে দুটো সেঞ্চুরি মারেন, আর একটা পঞ্চাশ। অবশ্য ক্যাচ আর স্টাম্পিং মিলে নটা শিকারও পকেটে ছিল।   

পরবর্তী কালে বহুবার ব্যাট হাতে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, টেস্ট ম্যাচে নয়-দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ইনিংস বাঁচিয়েছেন। এমনকি দুটো সেঞ্চুরিও আছে, কিন্তু বরাবর সেই নাইটওয়াচম্যান তকমাটা গায়ে সেঁটে থেকেছে। কোনো ক্যাপ্টেন বা টীম ম্যানেজমেন্ট কখনো ভরসা করে তাঁকে লোয়ার-মিডল অর্ডারে আনার সাহস দেখাতে পারেননি। যদি পারতেন, তাহলে কিরমানির ক্যারিয়ারটা এত দ্রুত শেষ হয়ে যেত না। আর পাঁচসাত বছর অনায়াসে খেলতে পারতেন, অন্তত টেস্ট-এ। যদি উইকেটকীপারদের ব্যাটিং স্ট্যাটস্ দেখা যায়, কিরমানি আজও আছেন প্রথম ২০-তে, সামনে ভারতীয় হিসেবে শুধু ধোনি।

তবে শুধু ব্যাটিং নয়, কিরমানিকে দেখতে হবে একটা কমপ্লিট প্যাকেজ হিসেবে। কীপিং আর ব্যাটিং-এর এই সমান পারদর্শিতা, এই ব্যালেন্স, খুব একটা কেউ দেখাতে পারেননি তারপর। অন্তত ধোনি আসার আগে অবধি ত নয়ই। কিরমানি আর ধোনির মাঝখানে উনিশ বছরে তেরোজন উইকেটকীপার এসেছেন এবং গেছেন, তার মধ্যে কিরন মোরে আর নয়ান মঙ্গিয়াকে বাদ দিলে কিরমানির ধারেকাছেও কেউ পৌঁছোতে পারবেননা কীপিং দক্ষতার দিক দিয়ে। ব্যাটিং-এ হয়তো চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত পারবেন, তবে তিনি স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান বেশি কীপার কম ছিলেন। আর কীপিংএর দিক দিয়ে কিরমানি এই তিনজনের থেকেই যে এগিয়ে, এটা আজ মেনে নিতে হয়তো অসুবিধে হবে না আর।

১৯৯৪-৯৫-এ মাস্টার্স কাপ চলছে, ৪৫-ছুঁইছুঁই কিরমানি খেলছেন ভারতের হয়ে আবার, অবশ্য তখন প্রাক্তন তকমা লাগা। গাভাসকারও আছেন সেই দলে। সাতটা ক্যাচ আর পাঁচটা স্টাম্পিং, তার মধ্যে একবার গাভাসকার বলেই ফেলেছিলেন, এই পারফরমান্স দেখে মঙ্গিয়াও লজ্জা পাবেন। হ্যাঁ,মঙ্গিয়া তখন তাঁর টপ ফর্মে।

যাই হোক, সেই কিশোর ছেলেটি স্কুল ক্রিকেট ছেড়ে খুব দ্রুতই ঢুকে পড়লো ডোমেস্টিক ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে। কর্ণাটকের হয়ে অভিষেক হল মাত্র আঠেরো বছর বয়েসে, ১৯৬৭তে। তারপর ১৯৭১এ সুযোগ এলো ভারতের হয়ে ইংল্যান্ড ট্যুরে শামিল হওয়ার। সেই টীমে ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার আছেন, এছাড়া কৃষ্ণমূর্তিও আছেন দ্বিতীয় উইকেটকীপার হিসেবে, তবুও তরুন কিরমানিকে নেওয়া হয়েছিল অনেকটা ট্রেনী হিসেবেই, অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যে, প্রধানত কাউনটি ম্যাচগুলো খেলার জন্যে।

সবথেকে প্রিয় যেটা, ব্যাটিং এবং কীপিং ছাড়া, সেটা ছিল ঘুম। টীমের ম্যানেজার রামপ্রকাশ মেহরা কিরমানিকে বললেন এই সুযোগে অ্যালান নটের কীপিং ভাল করে স্টাডি করতে। কিরমানি জানালেন নিশ্চয়ই, তিনি একেবারে মাঠে সাইটস্ক্রীন-এর ধারে বসে স্টাডি করবেন। এই বলে তিনি কেটে পড়লেন, প্যাভিলিয়নে একটা কোনা খুঁজে নিয়ে জম্পেশ ঘুম তারপর। 

এভাবে আবার ১৯৭৪এর ইংল্যান্ড ট্যুর এবং ১৯৭৫এর ওয়ার্ল্ড কাপ সাইড লাইনের ধারে বসেই কেটে গেল, কারন ইঞ্জিনিয়ার তখনো খেলছেন। অবশেষে ১৯৭৬এ নিউজিল্যান্ড ট্যুরে ডেব্যু হল, আর দ্বিতীয় টেস্টেই ছটি শিকার পকেটে। এটা এখনও ওয়ার্ল্ড রেকর্ড, অবশ্য ধোনি, ঋদ্ধিমান সাহা এবং হালফিল ঋষভ পন্থ, সবাই এই রেকর্ড ছুঁয়েছেন কিন্তু ভাঙতে পারেননি।

তারপর দুটো বছর বড়ই সুন্দর। ১৯৭৭এ নিউজিল্যান্ড যখন ফিরতি ট্যুরে ভারতে খেলতে এলো, কিরমানি ব্যাটিং অ্যাভারেজএ সবার উপরে, প্রায় ৬৫%। তারপর অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে ৩০৫ রান, সঙ্গে চমকপ্রদ কীপিং। একাধারে বেদী, চন্দ্রশেখর, প্রসন্ন এবং ভেঙ্কটরাঘভনকে কীপ করা, তাও উৎকর্ষতার সঙ্গে। জ্যাক ফিঙ্গলটনের মতো সমালোচকও বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে এটি তাঁর দেখা অন্যতম সেরা কীপিং প্রদর্শন।

ঠিক সেই সময় কেরি প্যাকার নিজের গুটি সাজাচ্ছিলেন। ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট প্রায় সব দেশ থেকেই বাছাই করা ক্রিকেটারদের তুলে নিয়েছে, শুধু ভারতে তখনো দাঁত ফোটাতে পারেনি। ভারত থেকে শুধু দুটি নাম প্যাকারের লিস্টে ছিল – গাভাসকার এবং কিরমানি। অস্ট্রেলিয়া ট্যুর চলাকালীন এই দুজনের সাথে প্যাকার কথাও বলেন, এবং দুজনেই পত্রপাঠ অফার ফিরিয়ে দেন। কিন্তু তদানীন্তন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড চেয়ারম্যান চিন্নাস্বামী সাহেবের এই ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হয়নি। ফল – ১৯৭৯ ইংল্যান্ড ট্যুরের টীম ঘোষণা হওয়ার সময় গাভাসকারের ক্যাপ্টেনসি গেল, এলেন ভেঙ্কটরাঘভন – এবং ফর্মে থাকা কিরমানিকে সরিয়ে নিয়ে আসা হল সুরিন্দার খান্না / ভরত রেড্ডি কে।

কিরমানি ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিসে ছিলেন। বাদ পড়ার খবরটা দেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, এবং কিরমানিকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদেই ফেলেন। কিরমানির ভাষায়, “আই ওয়াস ড্রপড লাইক এ হট ব্রিক, ফর নো ফল্ট অফ মাইন”। স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরেন কিরমানি, ড্রাইভারকে বলেন চালিয়ে যেতে ননস্টপ, যতক্ষণ না তিনি থামতে বলছেন।

ইংল্যান্ড সিরিজ হেরে গেল ভারত এবং তারপর ১৯৭৯ ওয়ার্ল্ড কাপএ উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারলেন না খান্না এবং রেড্ডি। ওদিকে কিরমানি এই সময়ে নিজের রিফ্লেক্স স্পীড এবং ফিটনেস আরও বেশ খানিকটা ধারালো করে কামব্যাক-এর জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। কামব্যাক হল ১৯৭৯এ অস্ট্রেলিয়া সিরিজে। সেই সিরিজে কিরমানির প্রথম সেঞ্চুরি, নাইটওয়াচম্যান হিসেবে বিশ্বে তিন নম্বর।

তারপর ১৯৭৯-৮০তে পাকিস্তান সিরিজ। নিজের কীপিংকে ক্রমশই উন্নত করে চলেছিলেন কিরমানি, ফলস্বরূপ ১৭টা ক্যাচ আর দুটো স্টাম্পিং – ওয়ার্ল্ড রেকর্ড যেটা এতদিন নরেন তামানের দখলে ছিল সেটায় ভাগ বসালেন। এই রেকর্ড ছুঁতে পেরেছেন একমাত্র পন্থ, এই কিছুদিন আগে। তাঁরই নেমসেক, সইয়দ ‘জাহির আব্বাস’ কিরমানির মারা একটি সূক্ষ্ম লেগ গ্লান্স উড়ে গিয়ে তালুবন্দি করেছিলেন চেন্নাই টেস্টে। জাহির নিজেই বিশ্বাস করতে পারেননি যে এই শটটা কিরমানি তালুবন্দি করে ফেলেছেন, মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে।

আসলে এই কামব্যাক-এর পর একটা বড়সড় পরিবর্তন ঘটেছিল কিরমানির কীপিং-এ। এর আগে ছিল স্পিন চতুষ্টয়কে সামলানোর দায়িত্ব, কিন্তু এখন তাঁরা অস্তমিত। এসে গেছেন কপিল, রয়েছেন ঘাউরি এবং নবাগত রজার বিনি। দুর্দান্ত মানিয়ে নিয়েছিলেন কিরমানি, এবং তাঁর লেগসাইড টেক দেখার মতো হয়ে উঠেছিলো।

১৯৮১তে ভারত অস্ট্রেলিয়া সফরে গেল টেস্ট খেলতে। ১-০ তে পিছিয়ে সেই বিখ্যাত তৃতীয় টেস্টে, মেলবোর্নে। ক্ষিপ্ত গাভাসকার চৌহানকে সঙ্গে নিয়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়েছিলেন ডেনিস লিলির বলে এলবিডাবলু হয়ে, এবং লিলির স্লেজিং-এ মেজাজ হারিয়ে। ড্রেসিংরুমে কিরমানি তখন একরকম ঠেলেই মাঠে পাঠালেন ম্যানেজার শাহিদ দুরানিকে, “সাহাব, আপ যাইয়ে অর রোকিয়ে ইনকো”! চতুর্থ ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ১৪৩ রানের সামান্য পুঁজি তাড়া করছে, তবে গোড়ার দিকে দুটো উইকেট হারিয়ে একটু চাপে আছে। সেই সময় দিলীপ দোশির বলে গ্রেম উডকে দুর্দান্ত একটা লেগসাইড স্টাম্পিং করলেন কিরমানি। তা দেখে উচ্ছ্বসিত রিচি বেনো ধারাভাষ্যে বলে উঠলেন, “দিস ইস দ্য বেস্ট লেগসাইড স্টাম্পিং আই হ্যাভ সীন ইন মাই লাইফ”।

সেই ম্যাচ স্মরণীয় হয়ে থাকবে সেই ইনিংসে কপিলের লড়াইয়ের জন্য, ২২ রানে পাঁচ উইকেট, হ্যামস্ট্রিঙের চোট নিয়ে। অস্ট্রেলিয়া ৫৫/৫, ব্যাট করছেন প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান অ্যালান বর্ডার। গেম-চেঞ্জার মোমেন্ট – কপিলের বলে আবার সেই লেগসাইডে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত একটা ক্যাচ নিলেন কিরমানি। কিরমানির নিজের পছন্দের শ্রেষ্ঠ ক্যাচ। চ্যানেল নাইন তারপর তাদের ‘ক্লাসিক ক্যাচেস’ শো শুরু করতো এই ক্যাচটা দেখিয়ে।

১৯৮১-৮২র ইংল্যান্ড সিরিজে আরও এক রেকর্ড করে বসলেন কিরমানি। তিন টেস্টের সিরিজে ইংল্যান্ড মোট ১৯৬৪ রানের পাহাড় বানিয়ে ফেললো, কিন্তু কিরমানি একটাও বাই দেননি এর মধ্যে। ততদিনে নাম করে ফেলেছেন কিরমানি, তখনকার সময়ে সেরাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন।

তবে সর্বশ্রেষ্ঠ যে তিনিই, সেটা গডফ্রে ইভান্স জানিয়েই দিলেন। ১৯৮৩ ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালের পর ভারতীয় টীম ড্রেসিং রুমে হাজির হলেন প্রবাদপ্রতিম এই বর্ষীয়ান উইকেটকীপার, কিরমানির হাতে তুলে দিলেন স্মারকটি। রুপোর গ্লাভস, তার মাঝখানে রুপোর একটা বল, আর তার নিচে খোদাই করা, ‘ওয়ার্ল্ড’স বেস্ট উইকেটকীপার‘। কিরমানির এটাই সেরা ‘ক্রিকেটিং মোমেন্ট’।

এই রেশ ধরে রেখেছিলেন কিরমানি তার পরের সিরিজগুলোতেও। ১৯৮৩তে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন ভারতে টেস্ট আর ওয়ানডে সিরিজ খেলতে এলো, আর দুরমুশ করে বেরিয়ে গেল ভারতকে, সুনীল গাভাসকার তারই মধ্যে ডন ব্র্যাডম্যানকে টপকে গেলেন তাঁর তিরিশ নম্বর সেঞ্চুরিটি হাঁকিয়ে। সেই চেন্নাই টেস্টে গাভাসকার যখন ২৩৬ নট আউট, কিরমানি অন্যদিকে ৬৩ নট আউট, দুজনের মধ্যে ১৪৩ রানের পার্টনারশিপ।

১৯৮৪-৮৫তে ইংল্যান্ড ভারতে এলো টেস্ট আর ওয়ানডে সিরিজ খেলতে, একেবারে ভাঙা টীম নিয়ে। প্রথম টেস্টেই জিতে গেল ভারত, আর  কিরমানি তাঁর দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটি পেলেন, ২৩৫ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে, সপ্তম উইকেটে।  কিন্তু ধরে রাখা গেল না। দ্বিতীয় টেস্ট ফিরোজ শাহ কোটলায়, ম্যাচ বাঁচাতে গিয়ে ছয় মারতে গিয়ে আউট হলেন কপিল, বাদ পড়লেন কলকাতা টেস্টে। সন্দীপ পাটিলও বাদ, দলে ঢুকলেন আজহারউদ্দীন। অতিরিক্ত সতর্ক অধিনায়কত্বের জন্যে বিদ্রুপিত হলেন গাভাসকার। পরের টেস্ট চেন্নাইয়ে আবার হেরে গেল ভারত, এবং শেষমেশ টেস্ট সিরিজও।

এই হার হজম করা কঠিন ছিল, এবং নির্বাচকমণ্ডলীর সামনে এটাই সুযোগ ছিল কিছু নতুন মুখকে সুযোগ দেওয়ার। ওয়ানডে সিরিজে বাদ পড়লেন কিরমানি, যদিও টেস্টে তাঁর পারফরমান্স খারাপ বলা চলে না। প্রথম ওয়ানডেতে দলে এলেন মোরে, এবং তৃতীয় ওয়ানডেতে অভিষেক হল এক তরুন তুর্কির, যাকে গাভাসকার এক নজরেই পছন্দ করে ফেললেন এবং বললেন যে একে না নিয়ে তিনি আসন্ন বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাবেন না।

সদানন্দ বিশ্বনাথ, আরও এক কর্ণাটকি কীপার। এসেছিলেন ভরপুর প্রতিভা নিয়ে, দুর্দান্ত স্টাম্পার এবং দারুন মারকুটে ব্যাটসম্যান। ওয়ানডের পক্ষে একেবারে আদর্শ। ১৯৮৫র বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ জেতার কৃতিত্ব গাভাসকার অনেকাংশেই অর্পণ করেছিলেন বিশ্বনাথের ওপর। আরও একটা ব্যাপার বিশ্বনাথ আমদানি করেছিলেন মাঠের মধ্যে, সেটা হল অ্যাগ্রেসিভনেস। কিরমানি ছিলেন একেবারে ক্লাসিক কীপার, উইকেটের পিছনে ধিরস্থির, মাঝে মধ্যে ফার্স্ট স্লিপের সঙ্গে একআধটা চুটকি শেয়ার করা, একটু হালকা হাসিতামাশা, এই অবধি। কিন্তু উইকেটের পিছন থেকে বোলারকে চিয়ার করা, সবাইকে মোটিভেট করা, এবং গগনভেদি চিৎকারের সঙ্গে আপীল করা – এগুলো বিশ্বনাথের আমদানি।

যদি আজকের যুগ হত, যেখানে বিভিন্ন ফরম্যাটের জন্য টীম আলাদা বাছা হয়, কিরমানি নিশ্চিত থেকে যেতেন টেস্ট কীপার হিসেবে, অন্তত আরও কয়েক বছর। বিশ্বনাথ চালিয়ে যেতে পারতেন ওয়ানডেতে। কিন্তু সেটা হয়নি, এবং সেই সময়কার শক্তিশালী ‘বম্বে লবি’র বদান্যতায় ওয়েস্ট জোনের মোরে / পণ্ডিতদের ঠেকিয়ে রাখা যায়নি বেশিদিন। বিশ্বনাথ দ্রুতই বিদায় নিলেন।

তবে কিরমানি আবার ফিরে এলেন। বেনসন অ্যান্ড হেজেস পরবর্তী শ্রীলঙ্কা ট্যুরে বিশ্বনাথের পারফরমান্স দাগ কাটতে পারল না, এবং ১৯৮৫-৮৬র অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে আবার কিরমানিকে দেখা গেল। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ পুরো খেললেন, ভালই খেললেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তী ট্রাই-নেশান ওয়ানডে সিরিজের গোড়াতেই চোট পেয়ে ছিটকে গেলেন, দলে ঢুকে পড়লেন মোরে।

কিরমানি আর কামব্যাক করতে পারেননি। বলা ভালো তাঁকে আর কামব্যাকের সুযোগ দিতে চাননি নির্বাচকরা। অবশ্য ফর্মে থাকা একজন প্রতিষ্ঠিত প্লেয়ারকে শুধুমাত্র একটা চোটের সুযোগ নিয়ে টীমের বাইরে করে দেওয়ার সাহস বা দূরদর্শিতা ভারতীয় নির্বাচকেরা আর খুব একটা দেখাতে পারেননি। কিরমানি কিন্তু তখনো হাল ছাড়েননি, নিজেকে ফিট রেখেছেন এবং লাগাতার ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলে গিয়েছেন ১৯৯৪ অবধি। কর্ণাটকের হয়ে রাহুল দ্রাভিড / ভেঙ্কটেশ প্রসাদদের সাথেও ড্রেসিংরুম শেয়ার করেছেন একসময়।

কিরমানি পরে মাস্টার্স কাপ তো খেলেইছেন, ১৯৯৭-৯৮তে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপও খেলেছেন। তবে শেষবারের মতো মাঠে নেমেছিলেন ২০০৭-০৮এ, শ্রীলঙ্কাতে, কেরালা ভেটারান্স-দের হয়ে। দুটো ম্যাচে তিনতে ক্যাচ, আর সঙ্গে বাষট্টি রান।

তুলনা তো করা যায় না ওভাবে, করা উচিতও নয়। কিরমানি মুলত টেস্ট ম্যাচ প্লেয়ার ছিলেন। ধোনি তিনতে ফরম্যাটেই অসাধারন। তবে একজন আছেন এখন যিনি অনেকটা কিরমানির ধাঁচে কীপিংটা করে চলেছেন, তিনি ঋদ্ধিমান সাহা।

ধোনি আর কিরমানির কিছু স্ট্যাটস্ পাশাপাশি রাখলে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। দুজনেই প্রায় কাছাকাছি সংখ্যক টেস্ট খেলেছেন, সে তুলনায় ধোনির ক্যাচের সংখ্যা অনেক বেশি। তবে সেটা হয়তো অনেক ভালো বোলিং অ্যাটাকের জন্যে, যেটা কিরমানির সময় ছিলনা। কিন্তু দুজনেই তুখোড় স্টাম্পার, তাঁদের শিকারের সংখ্যাও এক, ৩৮। স্টাম্পিং রেকর্ডবুকে দুজনেই যুগ্মভাবে তিন নম্বরে, আজও। ধোনির বেশিরভাগ শিকার পেস বোলিং-এর সাথে, ৪৭টি ইশান্ত শর্মা এবং ৪৩টি জাহির খান। কিরমানির সিংহভাগ এসেছে স্পিন চতুষ্টইয়ের সঙ্গে, মোট ৯৮টা।

তবে ‘কট-কিরমানি-বোল্ড-কপিল’ হিসেবে আজও জ্বলজ্বল করছে ৫৩টি নাম। কপিলের সমকক্ষ অন্তত আরও একজন পেসার যদি সেসময় ভারতীয় দলে থাকতেন, তাহলে ১৬০টি ক্যাচের সংখ্যাটা আরও অনেক বাড়ত অবশ্যই। সাদা পানামা হ্যাট পরে, হাতে চিরসবুজ সেই দস্তানায় আরও অনেকদিন উইকেটের পিছনে ওঁত পেতে থাকতেন কিরমানি, আর অকস্মাৎ এক লেগসাইড ডাইভে ছোঁ মেরে মাটি থেকে তুলে নিয়ে বল আকাশে ছুঁড়ে দিতেন এই দস্তানাবাজ। পালকের মতো ভাসতে ভাসতে সেই বল আবার এসে জমা হত সেই দস্তানায়, পরম নির্ভরতার সাথে, নিরাপদ আশ্রয়ে।

similar post : রাজার খেলা ক্রিকেট

One comment

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s