বেঁটেখাটো ছোট্ট মানুষটি ক্রিজে পৌঁছে গেছেন। প্যাভিলিয়ন থেকে পিচ অবধি লম্বা পথ হেঁটেছেন নিজস্ব স্টাইলে, দুলকি চালে খানিকটা ঔব্ধত্য কিন্তু বাকিটা নিখাদ প্রত্যয় প্রকাশ পেয়েছে। ব্যাট-সমেত হাত কয়েকবার শূন্যে ঘোরানো হয়ে গেছে, ব্যাটটাকে প্যাডে দুবার ঠুকে নিয়ে আবার ডান হাতে তুলে আলগা করে ডান কাঁধের ওপর ফেলে রাখা। লেগস্টাম্প গার্ড নিলেন, আম্পায়ারকে বাঁহাতের তর্জনী তুলে দেখিয়েছেন। পানামা টুপি আরেকবার ঠিকঠাক করে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিল্ড সাজানো দেখছেন। উইকেটের পিছনে তিনটে স্লিপ আর গালি, সামনে বাঁদিকে ফরওয়ার্ড শর্ট লেগ – দেখেও দেখছেন না কি? এইবার স্টান্স নিচ্ছেন, দূর প্রান্তে সাইটস্ক্রীন-এর সামনে থেকে দৌড় শুরু করতে তৈরি ম্যালকম মার্শাল।
স্টান্স নিচ্ছেন সুনীল মনোহর গাভাসকার, আর শান্ত হয়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে সবুজ মাঠ আর গ্যালারী। চুপ করে রুপকথা শোনার মতো ধীর, মহাসাগরে আদিম দ্বীপের মতো স্থির, হাজার মানুষের চোখ ছুটন্ত মার্শালের হাতে লাল বলটার গতি ঠাহর করার জন্যে তৈরি। ক্লাইমাক্সের চরমে এসে লাফিয়ে উঠে ডেলিভারি কমপ্লিট করলেন মার্শাল, আর সেকেন্ডের এক সামান্য ভগ্নাংশের মধ্যে ব্যাকফুটে চলে গিয়ে মুখের কাছে ব্যাট নিয়ে এলেন গাভাসকার। বিষাক্ত বাউন্সারটা তীব্র গতিতে আছড়ে পড়ে ব্যাটের কানায় লেগে উড়ে গেল স্কোয়ার লেগের দিকে, জ্যা-মুক্ত তীরের মতো ছিটকে উঠে তালুবন্দি করলেন উইনস্টন ডেভিস।
গ্যালারীর কিন্তু সেদিকে নজর নেই। অন্য এক অসম্ভব, ভয়ঙ্কর দৃশ্য তার চোখের সামনে। গাভাসকারের ব্যাট উড়ে গিয়ে পড়েছে ফরওয়ার্ড শর্ট লেগের মাথা টপকে পিছনে, নগ্ন হাতে ক্রিজে দাঁড়িয়ে অসহায় হয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছেন বিশ্বের সেরা ওপেনিং ব্যাটসম্যান। গ্ল্যাডিয়েটরের হাতের তরোয়াল ছিটকে পড়লে তার লড়াই শুধু শেষই নয়, সাথে ভেঙে চুরমার অ্যাম্ফিথিয়েটারে বসে সেই দৃশ্য দেখা সব মানুষের প্রতিরোধ।
বিষণ্ণ শরীরটাকে টানতে টানতে মাঠের বাইরে নিয়ে আসছেন গাভাসকার, আর টেলিভিশনের সামনে বসে টুপি আছড়ে ছুঁড়ে কেঁদে ফেললো এক কিশোর ছেলে। তিনদিন আগে এই মাঠেই একশো চুরানব্বই রানের স্বর্গীয় এক ইনিংস খেলে গেছেন গর্ডন গ্রীনিজ, কিন্তু ছেলেটির ঈশ্বর এ কি করলেন? দুই ইনিংসের কোনটাতেই দশের ঘরেও পৌঁছতে পারলেন না। তবুও সেটা বড় কথা নয়। আজ যা ঘটলো, তা এক দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেড়াবে সারাজীবন, আর ক্রিকেট খেলা দেখবে না সে।
এই টেস্ট ম্যাচের পর গাভাসকারকে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন দেশবিদেশের বেশ কিছু ক্রিকেট পণ্ডিত এবং সাংবাদিক। কিন্তু, কোনো অতি বড় আশাবাদীও যা স্বপ্ন দেখেননি তাই ঘটেছিল পরের টেস্ট ইনিংসে। মার্শাল, হোল্ডিং, ডেভিস এবং ব্যাপটিস্ট-এর আগুনে বোলিং তছনছ করে জীবনের দ্রুততম শতরানটি করেছিলেন গাভাসকার, মাত্র একানব্বই বলে। মার্শালকে হুক মেরে মাঠের মাইরে ফেলে দিয়েছিলেন। আর সেই সুবাদে ডন ব্র্যাডম্যানের উনতিরিশতম শতরানের মাইলস্টোনটিও স্পর্শ করে ফেলেছিলেন। মাঠের মধ্যেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা একে একে এসে হাত মিলিয়ে যান গাভাসকারের সাথে, স্বয়ং ভিভ রিচার্ডস মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানান তাঁকে।
রাজার খেলা এই ক্রিকেট, এভাবেও ফিরে আসা যায় এখানে। এখানে শেষ বলে কিছু নেই, প্রতি মুহূর্তেই হতে পারে এক রুপকথার শুরু।
সে দিনগুলো ছিল টেস্ট ক্রিকেটের। যদিও ওয়ানডে ততদিনে এসে গেছে, এবং কপিলদেব নিখাঞ্জ লর্ডস-এর ব্যালকনিতে কিছুদিন আগেই বিশ্বকাপ তুলে ধরেছেন, তবুও ওয়ানডে তখনো টেস্ট ম্যাচের লেজুড় হিসেবেই থাকতো। যিনি ভালো টেস্ট খেলেন, তিনি ভালো ওয়ানডেও খেলতে পারবেন সেটাই স্বাভাবিক ছিল, কারন প্রতিভার বিচার হতো টেকনিক আর টেমপারামেন্ট দিয়ে। আর ওয়ানডেতেও ধ্রুপদী ঘরানার ছাপ স্পষ্ট। পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচে প্রথম দশ পনেরো ওভার উইকেট আগলে খেলো, রান-রেট তিন বা সাড়ে তিন হলেই যথেষ্ট। পঁচিশ থেকে তিরিশ ওভারে রান-রেট একটু বাড়িয়ে নাও চারের আশেপাশে, কিন্তু উইকেট যেন থাকে। শেষ দশ ওভার চালাও, আড়াইশো পেরোতে পারলেই ভালো টার্গেট, দুশো আশি হলে তো কথাই নেই।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, যুদ্ধ একদিনে – বা এক ওভারে – জেতা যায় না। তার জন্যে ধৈর্য লাগে, সংযম লাগে। একটু একটু করে সাজাতে হয় ইনিংসটাকে, ধর-তক্তা-মার-পেরেক রীতি নিয়ে বেশীদিন বা বেশী দূর যাওয়া যায় না। বুনিয়াদ যদি না হয় মজবুত, তাহলে অট্টালিকা ঝড় সামলাবে কি করে?
অনেকটা এরকমই বুঝেছিল আর শিখেছিল ছেলেটা, খেলাটা দেখতে দেখতে আর খেলতে খেলতে। ওপেন করতে যেত সাধারণত, তার খেলার স্টাইল স্টান্স সবেতেই গাভাসকারীয় অনুকরণের ছাপ স্পষ্ট। অফ ষ্টাম্পের বাইরের বল ছেড়ে দিত শেষ পর্যন্ত দেখে, লেগ ষ্টাম্পের শর্ট-অফ-গুড-লেংথ বল ব্যাকফুটে কোমরের কাছ থেকে ফ্লিক মারতো মিড উইকেট দিয়ে। প্রথম কয়েকটা ওভার বোলারকে দাও, বাকি দিনটা তোমার – এই মন্ত্র একেবারে গেঁথে গিয়েছিলো তার মনে। বাউন্সার পেলেই হুক মারতো না, কারন ডীপ মিড উইকেট বা ডীপ স্কোয়ার লেগে ফিল্ডার রয়েছে, টাইমিং ঠিক না হলে লোপ্পা ক্যাচ, আর না হলে মাথায় চোট – তখনো হেলমেট পরে ব্যাট করাটা ক্লাব ক্রিকেটে চালু হয়নি। তার থেকে সোজা ব্যাটে ব্যাকফুটে গিয়ে মুখের সামনে থেকে বাউন্সারটা মাটিতে নামাতো, একদম পায়ের কাছে। লাল বলটাকে পায়ের সামনে নতজানু হতে দেখে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠতো ছেলেটা, দৃপ্ত অথচ তৃপ্ত দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতো আগুন চোখে তাকানো বোলারের দিকে।
বড় হতে হতে আনুভব করেছিলো ছেলেটি, কি অদ্ভুত মিল এই ক্রিকেটের সঙ্গে জীবনের। বাউন্সার কি আসেনি জীবনে? প্রচুর এসেছিলো, আসতেই থাকে। কিন্তু সব বাউন্সারে হুক মারতে নেই, এটা শিখিয়েছিলো ক্রিকেট। আর এই মাটি কামড়ে পড়ে থাকা প্রথম কয়েক ওভার – এটাও কি প্রচণ্ড বাস্তব। লম্বা রেসের ঘোড়া হতে হবে, আর তার জন্যে প্রথমে দম সঞ্চয় করে রাখতে হয়। প্রতিপক্ষকে ভালো ভাবে না বুঝে না চিনে পাল্টা ফেরত দিতে নেই, তাতে বিপদ বেশী – পিচের বাউন্স না পড়তে পারলে স্কোয়ার কাট মারতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরতে হবে। তার চেয়ে একটু সবুর করো, হাতটা একটু জমে যাক, তারপর মন খুলে স্ট্রোক খেলো। দুপায়ের ওপর শরীরের ভার ঠিক ভাবে বিতরণ করে এগিয়ে পিছিয়ে খেলো, সাবলীল ড্রাইভ বা ঝলকানো কাট, দুটোই চোখ ধাঁধাবে।
সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজটা ছিল যেমন ম্যালকম মার্শালের, তেমনি গাভাসকারেরও। কিন্তু ছেলেটির চোখ কেড়েছিলেন আরও এক ওপেনিং ব্যাটসম্যান, গর্ডন গ্রীনিজ। জীবনের প্রথম দিকে কাউণ্টি ক্রিকেট খেলা গ্রীনিজের ছিল স্বভাবসিদ্ধ ক্যারিবিয়ান আক্রমণাত্মক স্টাইলের সঙ্গে ইংলিশ ডিফেন্স, আর এই মারাত্মক যুগলবন্দী তাঁকে করে তুলেছিলো অপ্রতিরোধ্য। টেস্টে তো বটেই, ওয়ানডে সিরিজেও বেশ কয়েকটি নয়নাভিরাম এবং পরম আকর্ষক ইনিংস খেলেছিলেন গ্রীনিজ, তার মধ্যে কানপুরে সেঞ্চুরি ছাড়াও জামশেদপুরে সেঞ্চুরি ছিল, আর ছিল প্রায় প্রতিটা ওয়ানডেতে হাফ-সেঞ্চুরি।
ছেলেটির মনে তখনি গ্রীনিজের কভার ড্রাইভের ফলো থ্রু গেঁথে গেছে। মনিন্দার সিং-কে মারা ড্রাইভটা শেষ করেছিলেন ব্যাটের পুরো সুইং-টা শেষ করে, একদম মাথার পেছনে ব্যাটটাকে নিয়ে এসে। কি ঔব্ধত্য, ভিভ রিচার্ডস ছাড়া এ জিনিস কেউ পারেননি। আবার ফ্রন্টফুটে ডিফেন্স করছেন যখন, তখন শান্ত সমাহিত। ছেলেটি আপনমনে শ্যাডো করতে শুরু করে দিলো, বাড়িতে আয়নার সামনে। আর বিকেলে মাঠে গিয়ে এর ট্রায়াল চলতে লাগলো।
গ্রীনিজের ব্যাটিং ছেলেটাকে শিখিয়েছিল, যেরকম বল সেরকম খেলা। যেখানে সাবধানী হওয়া দরকার সেখানে হও, কিন্তু অকারণ সব পরিস্থিতে নিজেকে গুটিয়ে রেখো না। সুযোগ বারবার আসে না, তাই যখন আসবে তখন মারো, ফেরত দাও, তবে না এই লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারবে।
এভাবেই চলছিল। এর মধ্যেই, খানিকটা অনাড়ম্বর ভাবেই, ছেলেটির জীবনে এক মোড় এলো, যেদিন ইডেন গার্ডেনস-এ একুশ বছরের লম্বা ছিপছিপে এক যুবককে দেখা গেলো ব্যাট হাতে মাঠে নামতে।
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ, ফিরোজ শাহ কোটলায় দ্বিতীয় টেস্টে ম্যাচ বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমে পাল্টা দিতে গিয়ে ছয় মারতে গিয়ে আউট হলেন কপিল, আর পরের কলকাতা টেস্টের জন্য তাঁকে বাদ দিয়ে বসলেন চাঁদু বোরদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিটি। ‘নো কপিল নো টেস্ট’ – এই স্লোগানে মুখর সেদিনের কলকাতা আর ইডেন গার্ডেনস। সেই একই কারনে বাদ পড়েছিলেন আরও এক তারকা ব্যাটসম্যান, সন্দীপ পাটিল। আর তাঁর বদলে সেই ছিপছিপে যুবকের অভিষেক।
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট, তাও কপিল বাদ, মাঠে লোক বেশ কমই, তবে আমাদের সেই ছেলেটি রয়েছে ঠিকই টেলিভিশনের সামনে। প্রথম দিন, ব্যাট করতে এসে স্বাভাবিক ধীরভাবেই শুরু করেছিলেন গাভাসকার, অংশুমান গাইকোয়াড-কে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু বেশিদুর যেতে পারলেন না, লাঞ্চের আগেই দুই ওপেনার প্যাভিলিয়ন ফেরত। মহিন্দর অমরনাথ আর দিলীপ ভেংসরকার-এর জুটি ভারতকে প্রায় চা-বিরতি অবধি টেনে নিয়ে গেলেন, কিন্তু রান বেশী উঠলো না। ভেংসরকার আউট হতেই সেই ছিপছিপে যুবকটির মাঠে আগমন। একটি দৃষ্টিনন্দন ব্যাকফুট কভার ড্রাইভে খাতা খুললেন যুবকটি। আর অকস্মাৎ, প্যাট পোককের বলে যুবকটির সহজ লেগসাইড স্ট্যাম্পিং-এর সুযোগ হাতছাড়া করলেন পল ডাউনটন।
ভাগ্যিস করেছিলেন, নাহলে হয়তো ক্রিকেটের ইতিহাসটাই লেখা হতো অন্য ভাবে। দ্বিতীয় দিন বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার পরে তৃতীয় দিনের শুরু থেকেই রবি শাস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে খেলা আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে দিলেন সেই যুবক। টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা ছেলেটির চোখের সামনে আস্তে আস্তে উন্মোচিত হলো নতুন এক ঘরানার ব্যাটিং। কব্জির জোরে তার চিন্তা-ভাবনায় এক নতুন মাত্রা দিলেন সেই যুবক, এতো সুন্দর হতে পারে ব্যাটসম্যানশিপ? ছেলেটির এতদিনের রপ্ত করা কপিবুক স্টাইলের পাশে কি ভীষণ রোম্যান্টিক এই নতুন মেজাজি ব্যাটিং। যুবকটির ঈষৎ ঝুঁকে পড়া স্টান্স আর সাবলীল স্কোয়ার ড্রাইভের ভালোলাগার শুরুয়াতি গায়কী পেরিয়ে যখন কব্জির কালোয়াতি শুরু হলো, তখন অফ-মিডল ষ্টাম্পের গুড লেংথ বল অবলীলায় চালিত হতে লাগলো স্কোয়ার লেগ বা মিড উইকেট বাউণ্ডারিতে।
তাঁর ক্যাপ্টেনের উপহার দেওয়া ফ্রেড পেরির সাদা টিশার্ট, এবং এক সাইজ বড় ঢলঢলে হেলমেট পরে মহম্মদ আজহারউদ্দীন তাঁর এক-একটা কব্জির মোচড়ে ইডেনের বুকে তুফান তুলেছিলেন সেদিন। একশো দশ রানের ইনিংসটি প্রায় সাড়ে তিনশো বল খেলে সাজানো, যা কিনা তাঁর পরবর্তী কালের মাপকাঠির তুলনায় বেশ মন্থর, তবুও জাত চেনানোর পক্ষে যথেষ্ট। দিনের শেষে নরমান কাওয়ান্স-এর বলে ডেভিড গাওয়ার-এর হাতে গালিতে তালুবন্দি হয়ে মাঠ ছাড়েন আজহার।
এই ঐতিহাসিক আগমনীর সাক্ষী ছিল এক বিসর্জনও। দলের অতিরিক্ত ধীরগতির ব্যাটিং, মারাত্মক রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্ব এবং ‘নো কপিল নো টেস্ট’-এর জমা রাগ ইডেনের জনতা ঢেলে দিয়েছিলো গাভাসকারের ওপর, যার জেরে গাভাসকার ঘোষণা করেছিলেন আর কোনোদিন ইডেনে টেস্ট খেলবেন না। ছেলেটির ঈশ্বর সত্যিই আর কোনোদিন প্যাড গ্লাভস পরে নামেননি এই মাঠে টেস্ট খেলতে। তবে ক্রিকেটের মাহাত্ম এমনই, যে এক মহারথীর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে আরেক মহারথীর প্রবেশ। তাই ইডেন গার্ডেনস এক ডাকেই আপন করে নিল আজহারকে। এই মাঠ তাঁকে কোনোদিন নিরাশ করেনি, আর তিনিও প্রাণ খুলে উপহার দিয়ে গেছেন একের পর এক মনি মানিক্য।
এগারো বছর পর, নিজের ক্যারিয়ারের এক কঠিনতম সময়ে, সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অনিল কুম্বলেকে সঙ্গে নিয়ে এক মহাজাগতিক ইনিংস খেলেছিলেন আজহার। ব্রায়ান ম্যাকমিলানের বলে চোট পেয়ে জীবনে প্রথমবার মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া আজহার ফিরে এসেছিলেন টিমের সাত উইকেট পড়ে যাওয়ার পর, একশো ষাট রানের মাথায়, ফলো-অনের শমন মাথায় নিয়ে। চুয়াত্তর বলে সেঞ্চুরি মারার পথে আশ মিটিয়ে পিটিয়েছিলেন লান্স ক্লুজনারকে, ছাড়েননি আগুনপাখি অ্যালান ডোনাল্ডকেও। তাঁর শৈল্পিক রূপ ছেড়ে বেরিয়ে এসে সেদিন প্রথমবার পাওয়ার হিটিং-এর নিদর্শন রেখেছিলেন সেই ইডেনে, দুই ইনিংসে তাঁর চোখ–ধাঁধানো ব্যাটিং ভুলিয়ে দিয়েছিলো ম্যাচ হেরে যাওয়ার দুঃখ।
সেই আজহারও একদিন হারিয়ে গেলেন অকস্মাৎ। কিন্তু এভাবে হারানোর কথা তো ছিল না। ম্যাচ ফিক্সিং-এর জন্য আজীবন নির্বাসিত হওয়ার আগেও, যেটা কিনা হয়ে দাঁড়ালো তাঁর শেষ টেস্ট, সেটাতেও সেঞ্চুরি মেরেছেন। তবে ওই যে বললাম, ক্রিকেট কখনো থেমে থাকে না, আর তাই তাঁর ব্যাটন শেষমেশ শচিন তেনডুলকারের হাত ঘুরে ঠিক পৌঁছে গেলো প্রিন্স অফ কলকাতা’র হাতে।
প্রিন্স অবশ্য প্রিন্স একদিনে হননি। আর জেওফ্রি বয়কট না থাকলে ওই নামে কেউ ডাকতোও না তাঁকে। ঠিক যেমন রাহুল দ্রাভিড না থাকলে কেউ বলতো না, “অফসাইডে আছেন ভগবান, আর তার পরেই সৌরভ”।
সতের বছর বয়েসে দিল্লির বিরুদ্ধে রঞ্জি ফাইনালে ইডেনে যখন অভিষেক হচ্ছে সৌরভের, আমাদের সেই ছেলেটি তখন তৈরি হচ্ছে জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষার জন্যে। তবুও ফাঁকে ফাঁকে টেলিভিশনের সামনে এসে দেখে যাচ্ছে স্কোরটা। কুড়ি রানে দুই উইকেট পড়ে যাওয়ার পর মাঠে নেমে বাইশ রানের ছোট অথচ সপ্রতিভ ইনিংস খেলেছিলেন সৌরভ, তবে বাংলার রঞ্জি জয়ের আনন্দে সেই ইনিংসটি চাপা পড়ে যায়।
এর বছর দুয়েক পর যখন জাতীয় দলে সুযোগ আসে, তখন একেবারে ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাত্রা। মাত্র একটি ম্যাচ, প্রথম বলেই মার্শাল উইকেটের সামনে পা পেয়ে যান সৌরভের, কিন্তু বেঁচে যান তিনি। তবে বেশিদুর যাওয়া হলো না সে যাত্রা, তিন রান করে কামিন্সের বলে এল-বি- ডাবলু হয়ে ফেরেন, আর দ্বিতীয় ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। তার চার বছর পর লর্ডস টেস্টে খেলাও হতো না, যদি না নভজ্যোত সিধু আজহারের সাথে ঝগড়া করে দেশে ফিরে না আসতেন। তারপর তো ইতিহাস। দ্রাভিডকে সঙ্গে নিয়ে সেই পার্টনারশিপ, একশো একত্রিশ রানের সেই চান্সলেস ইনিংস, আর এক দ্বিতীয় ডেভিড গাওয়ারের জন্ম ক্রিকেটের পীঠস্থানে।
সে যাই হোক, আপামর ভারতবাসী সৌরভকে যত না মনে রাখবে তাঁর ব্যাটিং-এর জন্যে, তার থেকে বেশী মনে রেখেছে আর রাখবে অধিনায়ক হিসেবে, আর অবশ্যই তাঁর বারে বারে ফিরে আসার নাছোড় লড়াইএর জন্য। ততদিনে আমাদের সেই ছেলেটি পা রেখেছে জীবনযুদ্ধের ময়দানে। তাঁর লড়াই, আর তাঁর চোখে চোখ রেখে ফিরতি মার দেওয়ার সাহস, এই রসায়নে মজেছে ছেলেটি। আর এছাড়া দেখেছে, কিভাবে একটা ছন্নছাড়া অথচ প্রতিভাবান কিছু প্লেয়ারের সমষ্টিকে পরিণত করা যায় একটি দলে। কিভাবে তুলে আনতে হয় নতুন প্রতিভাকে, তাদের প্রতিপালন করতে হয়, সাহস দিতে হয়, প্রয়োজনে দুনিয়াকে রুখে দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হয়।
তাঁর শেষ টেস্টে প্রথম ইনিংসে মাত্র পনেরো রানের জন্য একটি সুন্দর সেঞ্চুরি হাতছাড়া করেন সৌরভ, আর দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম বলেই ফিরে যান। কাকতালীয় হয়তো হবে, গাভাসকারও তাঁর শেষ টেস্টে দুরন্ত ইনিংস খেলেও মাত্র চার রানের জন্য শতরান পাননি। তবে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, চ্যাম্পিয়নরা নিজে থেকেই সরে যান যখন তাঁরা বোঝেন যে এবার যাওয়া দরকার, ফর্ম থাকতে থাকতে। নাহলে নিয়তি সরিয়ে দিতে বাধ্য হবে।
এভাবেই ক্রিকেট, রোমান্স আর জীবনদর্শন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় যুগ থেকে যুগে। সে যুগ সাদা কালোই হোক বা রঙিন।
রঙ ভালো, কিন্তু বড় বেশী রঙ কখনো যেন বেরঙিন করে দেয় ক্যানভাসকে। এতো নীল, হলুদ, সবুজের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সেই আদিম সাদা শুভ্রতা। সাদা পোশাক, সাদা পানামা টুপি, সাদা থেকে একটু ঘোলাটে হয়ে যাওয়া একজোড়া প্যাড আর গ্লাভস পরিহিত ব্যাটসম্যান, সবুজ মাঠের মধ্যে ছড়ানো ছেটানো সাদা ফিল্ডাররা, লাল বল নাগাড়ে সাদা প্যান্টে ঘষে পালিশে ব্যস্ত বোলার, উইকেটের পেছনে লাল গ্লাভস হাতে ওঁত পেতে বসে থাকা উইকেটকীপার। আর, সাদা কোটের সঙ্গে একটু ব্যাতিক্রমী কালো প্যান্ট পরিহিত আম্পায়ারদ্বয়।
ছেলেটা নিজেকে খুঁজে পায় ঠিক মাঠের মাঝখানে, ব্যাটিং ক্রিজের পাশে। চোখ তুলে দেখে, দূরে বোলার তার দিকে পিছন করে হাঁটছে রানআপের দিকে। ছেলেটা একটু ঝুঁকে ঠিক করে নেয় ডান পায়ের প্যাডটা, তারপর গ্লাভসদুটো একটু টাইট করে নিয়ে ব্যাট হাতে স্টান্স নেয় মাথা নিচু করে। ঘাড় সোজা করে যখন আবার সামনে তাকায় সে, তখন চরাচর আবছা, শুধু সামনে হাল্কা সবুজ পিচ কার্পেটের মতো বিছিয়ে রাখা। তার দৃষ্টি স্থির, আলতো ভাঁজ করা দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো শরীরটা টানটান, ব্যাট ধরা বাঁহাতটা শক্ত, ডানহাতটা আলগা অথচ মজবুত। ছুটে আসছে বোলার, প্রায় বোলিং ক্রিজের কাছাকাছি পোঁছে গেছে, লাফ দিলো বলটা ছাড়ার আগে। শেষ মুহূর্তে তার হাতের গ্রিপ বলছে আউটসুইং, ছেলেটা বাঁ পা বাড়াল ব্যাকলিফট নিয়ে। প্রায় গুডলেংথ বলটা অফ স্টাম্প থেকে বাঁক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ফ্রন্টফুটে পেয়ে গেল তার ব্যাট, আর এক্সট্রা কভার দিয়ে তীরবেগে মাটি কামড়ে বেরিয়ে গেল অস্পষ্ট লাল রেখা। কপিবুক কভার ড্রাইভটার রেশ তখনো ধরে রেখেছে ছেলেটার ফলো-থ্রু।
ভোররাতের আবছা অন্ধকারে ঘুম ভেঙে যায়। নিঃশব্দে দুএক ফোঁটা জল চোখের কোল বেয়ে বালিশে জমা হয়। ভেজা স্বপ্ন চোখে আগলে রেখে আবার ঘুম আসে। আগামীর আলো অপেক্ষায় থাকে পুনরুদয়ের, যদি আবার ভবিষ্যতের গর্ভে জন্মায় ফেলে আসা সোনালি দিনের বীজ।
ভালো লিখেছেন ফলো করলাম ভাইয়া
LikeLike
সব বাউন্সারে যেমন হুক করতে নেই , সব ফুলটস বলকেও মাঠের বাইরে ফেলা যায় না – ক্রিকেট থেকে শেখা এই সত্য জীবনের প্রতিপদে কাজে লেগেছে … তাই তো ক্রিকেট আমাদের এত কাছের , এত আপন ..
ভালো লেগেছে লেখাটা – কৈশোরে আলাপ ছিল না , তাই একসাথে ওপেন করতে মাঠে নামা হয়নি … তবে চাকরি জীবনে একবার প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে নেমেছিলাম , খেলেছিলাম … সে স্মৃতি এখনও সমুজ্জ্বল ..
LikeLiked by 1 person