পর্ব – ৪
যুগান্তর
পুরনো কোনো বই হঠাৎ খুললে যখন অনেক টুকরো টুকরো ছেঁড়া পাতা উড়তে থাকে, তখন এলোমেলো সব পাতা একত্র করতেই সময় পেরিয়ে যায়। গুছিয়ে বই পড়া সে ক্ষেত্রে বড় কঠিন। তবে সে বইটা যদি কোনোদিন পুরো পড়া যায়, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, তাহলে স্বাদ পাওয়া যেতে পারে এক অন্যরকম উপন্যাসের।
এরকমই কিছ টুকরো পাতায় ধরা রয়েছে একাধিক যুগের গল্প। গল্পের প্রধান চরিত্রটি যুগ পেরিয়ে যুগান্তরেও প্রবাহমান, তাঁকে এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হয় ‘বহুমুখী’।
– দাদু –
ছফুট লম্বা শরীরটা বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও শিথিল নয়। বাড়ির পাশের সরু গলিটা দিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবী আর পাম্প-শু পরিহিত ব্যাক্তিটি সাইকেলটা বেশ কষ্ট করেই টানতে টানতে এনে ফেললেন গেট ছাড়িয়ে পাকা পিচের রাস্তার ওপর। সামনের রেশন দোকানের জমায়েতের মধ্যে থেকে কয়েক জোড়া কৌতূহলী চোখ এসে পড়েছে এদিকে। একটু দম নিয়ে সাইকেল সমেত কয়েকপা হেঁটে একটা ঝটকা মেরে ধুতি সামলে সাইকেলে আরোহণ। খানিকটা টলমল করে উঠেও ধাতস্থ হয়ে গেল সাইকেলটা। রাস্তা ধরে এগিয়ে, সামনের মোড়ে পাড়ার ছেলেদের ক্রিকেট খেলার জটলা পেরিয়ে ততক্ষনে বেশ সাবলীল ভাবে চালিয়ে চলেছেন আরোহী। বয়েস তাঁর যে প্রায় আশির কোঠায়, সেটা আন্দাজ করা বেশ কঠিন।
পেশায় ছিলেন ডাক্তার। দেশভাগের আগেও ডাক্তারি করতেন। তারপর ভাগাভাগি শেষে অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার মায়া কাটিয়ে এপারে বাদুড়িয়ায় পরিবার সহ আগমন এবং বসবাস শুরু। সেই সঙ্গে প্রাকটিসও শুরু। মিউনিসিপ্যালিটি’র চ্যারিটেবল ডিসপেনসরির মাধ্যমে লোকালয়ে ক্রমশ পরিচিত হয়ে ওঠা এক পরম নির্ভরযোগ্য ডাক্তার হিসেবে। তাঁর জনপ্রিয়তার বহু গল্প শোনা এবং কিছুটা নিজেও দেখা। বহু বছর আগে, আমার ছোটবেলায় – তখন তিনি কলকাতার বাসিন্দা – একবার আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন বাদুড়িয়া দর্শন করাতে। বাদুড়িয়া সংলগ্ন তারাগুনিয়ায় এক বিয়েবাড়ি উপলক্ষে যাওয়া। বিয়েটা কার ছিল জানতাম না, সে অর্থে নিমন্ত্রিতও ছিলাম না, তবু ওঁর সঙ্গে আছি তাই বাড়তি খাতির যত্নের শেষ ছিল না। তারপর যখন বাদুড়িয়া পৌঁছই, তখন সাদর আমন্ত্রণ, বিভিন্ন বাড়িতে পালা করে আতিথেয়তা এবং স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে তাঁর জনপ্রিয়তার আন্দাজ পেতে অসুবিধে হয়নি।
তিন ভাইয়ের মধ্যে ইনি ছিলেন মেজ। বড়জন কম বয়সে যখন মারা যান, তখন তিন নাবালক পুত্র সহ তাঁর পরিবারের দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে মেজ ভাইএর ওপর। তাঁর নিজের সংসারও তখন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। এই অবস্থায় দেশভাগ এবং এই জোড়া সংসার সমেত বাদুড়িয়ায় পদার্পণ। ভরা বাড়ি আরও ভরাট হয়ে ওঠে ক্রমশ; তাঁর পাঁচ পুত্র চার কন্যার সঙ্গে এই তিন ভাইও একসাথে বেড়ে ওঠে একই ছাতার তলায়।
বাদুড়িয়ার এই বাড়ি, এই ছেলেবেলার মায়াবী দিনগুলোর কথকতা – এ সবই আমার শোনা বহুবার। সেদিনের সেই পুত্র কন্যারা আজ মাঝবয়েস পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম বড় হয়েছে শহরের চার দেয়ালের সীমাবদ্ধতায়, তাদের কল্পনায় এই ফেলে আসা দিনগুলো ডানা মেলেও ঠিক মেলতে পারে না। যদি কোনোদিন এই প্রৌঢ়দের কোনো একজন কলম ধরেন, তাহলে সৃষ্টি হবে এক অপরুপ রুপকথা। ফিরিয়ে আনা যাবে এক বিলুপ্তপ্রায় সময়কাল, কিছু হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধ, এবং অনেক অনাবিল আনন্দের উপাখ্যান।
সময়ের সাথে বদলায় মানুষ। শুনেছি এক সময় এই মানুষটি ছিলেন রাশভারী, গুরুগম্ভীর, সাবেকী, রক্ষণশীল। তবে আমি যখন দেখেছি, তখন অবশ্য এসব কিছু বোধ হয়নি। আমার ছোটবেলায় অনেকটা সময় কেটেছিল ওঁর সান্নিধ্যে, এবং সেটা সম্ভব হয়েছিল কারন এই অন্তরায় অতিক্রম করে উনি নিজেই আমার কাছে এসেছিলেন। না হলে এতো বৈচিত্র অধরাই রয়ে যেত।
বাদুড়িয়ার পাট চুকিয়ে শেষমেশ একদিন কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে আসতেই হল কলকাতা শহরে। আমাদের বাড়ির খুব কাছে দুকামরার ভাড়া বাড়িতে উঠে এলো সংসারটি, ততদিনে অবশ্য ছোট হতে শুরু করেছে সংখ্যায় – সন্তানেরা ক্রমশ স্ব-জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছে এই পরিবার থেকে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতা শুধু ভৌগলিক, শেকড় সেই এখানেই। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা জমায়েত হয়েছেন আবার এই বাড়িতেই। এই ছোট্ট পরিসরের মধ্যেই জমে উঠেছে আড্ডা, পালিত হয়েছে সামাজিক অনুষ্ঠান, স্মৃতিচারণে নস্টালজিয়ায় সাময়িকভাবে ফিরে এসেছে পুরনো দিনগুলো। আর এর কেন্দ্রবিন্দুতে বরাবরই ছিলেন এই দীর্ঘকায় মানুষটি।
ডাক্তারি ছাড়তে পারেন নি, আর ডাক্তারিও ওঁকে ছাড়েনি। তাই সেভাবে আর প্র্যাকটিস না করলেও বাড়িতে কারো অসুখবিসুখ করলে তিনিই ভরসা। এমনকি কয়েকজন পাড়া প্রতিবেশীও নিয়মিত যাতায়াত করতেন ব্লাড-প্রেশার ইত্যাদি দেখিয়ে নিতে। নিজের একটা মাইক্রোস্কোপ ছিল, তাঁর সাহায্যে রক্ত পরীক্ষাও নিজেই করতেন যতটা সম্ভব। আমাকে অনেক কিছু শেখানোর ফাঁকে ব্লাড-প্রেশার মাপাও শিখিয়েছিলেন, আদ্যিকালের সেই মার্কারি স্ফিগম্যানোমিটার-এ। স্পষ্ট মনে আছে, কাঁচের ইঞ্জেকশান সিরিঞ্জ-এ নিডল পরিয়ে রক্ত নিলেন, তারপর পাতলা কাঁচের স্লাইডে দু-ফোঁটা রক্ত ফেলে আরেকটা স্লাইড দিয়ে ঘষে নিয়ে চাপা দিয়ে রাখলেন। পরে মাইক্রোস্কোপের তলায় ধরে যাচাই করা হবে কোন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস রয়েছে তাতে। পুরো ব্যাপারটা ঘটছে বাইরের ঘরে বড় চৌকিটার ওপর বসা অবস্থায়। রুগী এদিকে খোশগল্পে ব্যস্ত বাড়ির বাকি সদস্যদের সঙ্গে।
কোনোদিন যদি সকাল সকাল যাওয়া যেত ওই বাড়িতে, তাহলে দেখা যেত উনি বসেছেন বাজার থেকে সদ্য আগত মাছের থলিটা নিয়ে। কালো একটা রাবার ম্যাট, তার একপাশে রাখা কাটার, প্লায়ার সহ বেশ কিছু যন্ত্র, যেগুলো পোড় খাওয়া মিস্ত্রিদের হাতেই দেখা যায়। এই রকম বিভিন্ন যন্ত্র (এমনকি একটা আস্ত কুড়ুল পর্যন্ত) রাখা থাকতো খাটের তলায় একটা বড় কাঠের বাক্সে। তাতে কি নেই, পুরোদস্তুর টুলবক্স একটা। বিভিন্ন সাইজের স্প্যানার, রেঞ্চ, স্ক্রড্রাইভার, কাঁচি (তা দিয়ে চুল কাটতেও দেখেছি ওঁকে) সব সাজানো রয়েছে। ওই বাক্সটার ওপর আমার মারাত্মক লোভ ছিল এককালে, একটা চুক্তিও করে ফেলেছিলাম যে ওটার আমিই মালিক হবো একদিন। সে যাই হোক, সেই কাটার, প্লায়ার ইত্যাদি দিয়ে মাছ কাটতে দেখাটা ছিল এক বেশ আকর্ষক ব্যাপার।
সাইকেলটাও নিজেই রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। চেন অয়লিং করা, বা ব্রেক টাইট করা – এসব মামুলী ব্যাপার। চাকা পাঙ্কচার হলেও নিজেই সারাতেন। ডেনড্রাইট ছিল সর্বদা হাতের কাছেই। পুরনো দুএকটা রাবারের টিউবও ছিল। সেগুলো থেকে টুকরো কেটে, কোনাগুলো ফাইল দিয়ে সমান করে ঘষে নিয়ে, ভালো করে ডেনড্রাইট লাগিয়ে রাখা হতো। তারপর ঠিক জায়গায় সেটা চিপকে দিলেই হল।
সকালের মধ্যে এইসব দৈনন্দিন কাজকর্ম মিটে গেলে অবসর যাপন। তখনো টেলিভিশন ঢোকেনি বাড়িতে, রেডিওর খুব একটা ভক্ত ছিলেন না। তাই বিনোদনের উপকরণেও বেশ বিবিধতা ছিল।
প্রথম দেখি ওঁকে হাতে তৈরি কাপড়ের লুডোর ছক বানাতে। দুধারে কাঠের রুল লাগানো, অনেকটা প্রাচীন পুঁথি স্টাইলে বানানো। কাপড়টা কি কায়দায় পারচমেনট-এর মতো করতেন মনে নেই। তাতে ফ্যাব্রিক রঙ দিয়ে আঁকা হতো লুডোর ছকটা। তবে আরও ব্যতিক্রমী ছিল গুটিগুলো বানানোর প্রক্রিয়া। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ – এই চার রঙের টুথব্রাশ ব্যবহার করে বাতিল হয়ে গেলেই স্থান পেত ওঁর টুলবক্সে। আর সময়মত সেগুলো কেটেই তৈরি হতো লুডোর গুটি। ছোট ছোট টুকরো কেটে নেওয়া, এক একটা বড়জোর এক সেন্টিমিটার বাই আধা সেন্টিমিটার সাইজের। তারপর সেগুলো ভালো করে ফাইলিং করে মসৃণ করে নেওয়া। সবশেষে তৈরি হতো লুডোর ছক্কা। সেটা কাঠের টুকরো দিয়ে, পারফেক্ট কিউব আকারে কাটা। আর তার এক-একটা দিকে হাল্কা করে ড্রিল করে ফুটো করা গর্ত। যেমন, যেদিকে ছয় পড়বে, সেদিকে ছটা গর্ত। সেগুলো সাদা ফ্যাব্রিক রঙ দিয়ে ভরাট করা। সবশেষে টুকরোটা ভালো করে শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে পালিশ করা।
এইরকম লুডো যদি হয়, তাহলে খেলার সঙ্গীর অভাব ঘটে না। তাই জনা চারেক ঠিকই জুটে যেত। তার মধ্যে অবশ্যই আমি একজন। ঠিক একই ভাবে দাবার বোর্ডও বানিয়েছিলেন। আমাকেও দিয়েছিলেন বানিয়ে, আমি তখন দাবা খেলতে সবে শিখেছি।
দুপুর গড়িয়ে যেই বিকেল ঘনাতো, আর তারপর সন্ধ্যা নামতো শাঁখের ধ্বনি আর ধুপের গন্ধ সঙ্গে নিয়ে, তাস খেলার পালা তখন। একা একা পেশেন্স খেলা চলতো আপনমনে, মাঝে আমি আবার জুটতাম কোনোদিন এসে। তাসে হাতেখড়ি আমার ওঁর কাছেই। চার রকম পেশেন্স খেলা শিখিয়েছিলেন, এছাড়া টুকটাক ফিশ বা ব্রে। শিখে যাওয়ার পর পেশেন্স আমিই খেলতাম, উনি পাশে বসে দেখতেন আর আমার হাতের তারিফ করতেন। তাস শাফল করার কায়দাও শেখা এক ফাঁকে। এই সব শিক্ষার ফাঁকে ফাঁকে বলতেন, অনেকটা স্বগতোক্তি বা সতর্কীকরণ হিসেবেই, “তাস দাবা পাশা, তিন সর্বনাশা”।
পারিবারিক সম্পর্ক শুধুমাত্র পরিবারেই সীমিত থাকে না। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। এদেশে ছড়িয়ে পড়া পরিজনবর্গের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা, ওদেশে ফেলে আসা পরিচিত বন্ধুবর্গ, এবং সর্বপরী আত্মীয়সম প্রতিবেশী – এই সব বিভিন্ন এবং বিচিত্র রঙবেরঙের সুত্রকে একই গ্রন্থিতে বাঁধতে পারেন এমন মানুষ আজ বিরল, কিন্তু ইনি পারতেন, অবলীলায়। তার একটা বড় কারন তাঁর স্মৃতিশক্তি এবং অনাড়ম্বর আন্তরিকতা। এই বিশাল বিস্তৃত পরিবারটির প্রায় প্রতিটি মুখ তাঁর চেনা, প্রতিটি নাম মুখস্ত। তাই তিনি যখন গল্প বলতেন, তখন সেই গল্পের স্রোত কোন ধমনী বেয়ে কোন শাখায় প্রবেশ করছে আর কোন চরিত্রটিকে তুলে আনছে সেটা ঠাহর করা – অন্তত আমার পক্ষে – প্রায় অসম্ভব ছিল। তবুও সে গল্প শ্রুতিমধুর ছিল। শুনতে শুনতে কল্পনায় খানিকটা হলেও আলাপ হয়ে যেত সেই চরিত্রটির সাথে।
ছেলেবেলা গড়িয়ে আমার বড়বেলায় পদার্পণ, স্কুলজীবন শেষ করে কলেজ, আর তারপর চাকরি। শেষ দুই পর্বে ঘর ছেড়ে বাইরে। এর মধ্যে ওঁর সাথে যোগাযোগ কমে এলেও অপ্রাসঙ্গিক কখনই হয়ে পড়েননি। লম্বা ইনিংস খেলে শেষে নার্ভাস নাইনটিস-এর শিকার হয়ে যখন মাঠ ছাড়লেন, ততদিনে আমি সবে পিচের বাউন্স-এর সঙ্গে সড়গড় হওয়ার চেষ্টা করছি। যেদিনটিতে চলে গেলেন, সেই দোসরা মে তাঁরই প্রিয় খোকা, অর্থাৎ আমার বাবার প্রয়াণ দিবস, যাকে একসময় নিজে হাতে প্রাণপণ শুশ্রূষা করেও ধরে রাখতে পারেননি।
ডঃ আর সি ঘোষ, বা রাধাচরন ঘোষ যে যুগের মানুষ, সে যুগের অবসান ঘটেছে সাদা কালো সিনেমার সঙ্গেই। কিন্তু আজও সেই সব সিনেমা দেখতে বসলে চরিত্রদের দিকে চোখ আটকেই থাকে, সাদা কালোর পর্দা ভেদ করেও তাদের বর্ণময় উপস্থিতি ছাপিয়ে যায় সময়ের ব্যবধান।
স্তব্ধতার গান কান পাতলেই স্পষ্ট শোনা যায়।