সব চরিত্র কাল্পনিক নয় (৩)

Posted by

পর্ব –

চেনা মুখ, অচেনা মানুষ

এ-কথা বলতে গেলে ও-কথা চলে আসে। কোন ধাঁচ মেনে কথা বলা কি যায়, ছাঁচে ফেলে বাগে আনা কি যায় ভাবনাকে? তার চেয়ে তাকে ইচ্ছেমতো ভেসে যেতে দেওয়াই ভালো।

যুগ বদলায়, কিন্তু অভ্যেস বদলায় না। তাই যে সময় চলে গেছে, তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অবাস্তব হলেও অবান্তর নয়।  আর অকস্মাৎ, সেই প্রচেষ্টার মাঝেই, এক ঝলকে জীবন্ত হয়ে ওঠে সেই বিগত দিন, পলকে মিলিয়ে যাওয়ার আগে ক্যানভাসে ছড়িয়ে দিয়ে যায় রামধনু, আর তার রেশ রয়ে যায় গোধূলির পড়ন্ত আলোয়।

শঙ্করদা –

উত্তর কলকাতার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছি আজো। এ বড় বিচিত্র এক টান। পরশুরামের কচি-সংসদের নকুড়মামা দার্জিলিঙের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “এটা কি ভদ্দর লোকের থাকবার দেশ? চললে হাঁপানি, থামলে কাঁপুনি – কেন রে বাপু?” তা আমাদের উত্তর কলকাতা হল সেরকমই, যতক্ষণ আছো এখানে, হাজারো ঝামেলা – কিন্তু যেই একবার বেরিয়েছো এর বাইরে, জোরদার উইথড্রয়াল সিম্পটম শুরু হবে।

একটা সময় ছিল, যখন বেলগাছিয়া ভিলার সামনে থেকে ৩বি বা ৩ডি/১ বাসে জানলার ধারে বসে যাওয়ার বিলাসিতা উপলব্ধ ছিল। ধীরে সুস্থে বাসটা গড়িয়ে চলেছে পাইকপাড়া পেরিয়ে বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোর মোড় অবধি। একটু গতি বাড়িয়ে ব্রিজ পেরিয়ে আর জি কর, আর তারপর শ্যামবাজারে এসে ক্ষণিক বিশ্রাম। পাঁচমাথার মোড় থেকে বাঁদিকে বেঁকে সার্কুলার রোড ধরে সাবলীল ভঙ্গিতে পরপর পেরিয়ে চলা ফড়িয়াপুকুর, খান্না, সাহিত্য পরিষদ আর অবশেষে মানিকতলা। এখানে নামতে হবে। অবশ্য ৩ডি/১-এ চাপলে একটা বাড়তি স্টপ পেরিয়ে সুকিয়া স্ট্রীটের মোড়ে নামা যায়।

তা যেখানেই নামা হোক, বাকি পাঁচসাত মিনিটের পায়ে চলা পথ পেরোতে গিয়ে উত্তর কলকাতার নিজস্ব স্বাদ, বর্ণ আর গন্ধের সাথে মোলাকাত হতে বাধ্য। রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট থেকে বাঁক নিয়ে যেই হরিনাথ দে রোডে পা দেওয়া, অমনি সেই স্বাদ বর্ণ আর গন্ধের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ। মোড়ের মাথায় কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পাশ দিয়ে বিকেলের দিকে গেলে গরম শিঙাড়ার সুবাসে এক মন-কেমন করা আমেজ। তারপর একটু সাবধানে চলতে হবে, অকস্মাৎ ছিটকে আসা ফুটবল এবং বেসামাল খেলোয়াড়দের সামলে ফুটপাথ ধরে এগোলেই বাঁহাতে মনসামন্দির। তার আগে লাগোয়া বেদিতে বাৎসরিক দুর্গাপুজোর তোড়জোড় শুরু হয় মহালয়ার মাসখানেক আগে থেকেই। মন্দির পেরোলেই ডানদিকে একটা ঘিঞ্জি বস্তি, আর বাঁদিকে খানিকটা বেমানান ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে মেটে রঙের চারতলা সারিবদ্ধ ফ্ল্যাটবাড়ি। এটা সিআইটি হাউসিং এস্টেট, আমার মামার বাড়ির পাড়া। হাউসিং-এর লোহার গেটের পাল্লা বেশ তাকত দিয়ে ঠেললে খুলে যায়, আর কদাচিৎ কোন ট্যাক্সি ভেতরে ঢুকে হাওড়া স্টেশন ফেরত যাত্রী নামিয়ে ভিতরের আয়তাকার রাস্তা ধরে একটা পাক খেয়ে আবার এই গেট দিয়েই বেরিয়ে আসে। এই অঞ্চলের বাসিন্দারা যাতায়াত করে গেটটাকে হাল্কা টেনে ফাঁক করে।  ভেতরে ঢুকে ডানদিকে গেলেই প্রথমটা ছেড়ে দ্বিতীয় ব্লকটার চারতলা আমার গন্তব্যস্থান।    

কবে থেকে মামার বাড়ি যাতায়াত শুরু মনে নেই। তবে ওই দু-কামরার ফ্ল্যাটবাড়িটা একটা পরিচিত ঠিকানা হয়ে উঠেছিল অজান্তেই। শুধু বাড়িটা নয়, এ বাড়ি ঘিরে বেশ কিছু চরিত্র এবং তাদের আসা-যাওয়া, কথোপকথন, আড্ডা, গল্প সব মিলে একটা আজব আকর্ষণ ছিল ছোটবেলায়।

তখনকার দিনে বাজার করে দেওয়ার লোক চাইলে জুটে যেত। এমনই একজন মামার বাড়িতে বাঁধা বাজাড়ু ছিল, তার নাম ভানু। তাকে দেখতাম, রোজ সন্ধ্যেবেলায় ব্লকের সিঁড়িতে আধো অন্ধকারে বসে একরাশ আলু পটল ইত্যাদি ঢেলে সেগুলোকে ভাগাভাগি করতে। ভাগ করা হলে বিভিন্ন সাইজের থলিতে সেগুলো ভরে ফেলতো। আর তারপর সেই থলিগুলো পোঁছে দিতো বাড়ি বাড়ি। কতদিন ধরে সে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো জানিনা, তবে দিদার পর মামিমাদেরও দেখেছি সেই ট্র্যাডিশন বজায় রাখতে। খুব কৌতূহল হতো, কি করে ওজন মিলিয়ে মাল দিতো ভানু। এক-আধবার কেউ প্রশ্ন করলে এক বিচিত্র হাসি ছিল বরাদ্দ। তবে প্রশ্ন খুব একটা কেউ করতো না, কারন ভানু তখন একটু টলমল অবস্থায় বিরাজমান। সান্ধ্যকালীন জলপান সাঙ্গ হলে তার এই বাজার পর্ব শুরু হতো, তাই বেশী কিছু বলার বা শোনার অবস্থায় থাকতো বলে মনে হয় না। বহুবার শুনেছি, দিদা বলছে, “আনতে বললাম পটল আর তুমি আনলে চিচিঙ্গে, ও ভানু –“, কিন্তু ব্যস, ওই পর্যন্তই।    

মাঝখানে সেই আয়তাকার রাস্তাটা পেরিয়ে পাশের ব্লকগুলো সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে। আর সেই ব্লকের ছাদের পাঁচিল ধরে পায়চারি করতো চুলু। বয়েসে আমার মামাদের সমসাময়িক। তার নামটা ঠিক কি ছিল জানতাম না, তাকে সবাই চুলু বলেই ডাকতো। সত্য সাঁইবাবা মার্কা বিশাল চুলের বাহার, পাতলা চেহারা, মাঝারি হাইট। হাতকাটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি, সেটা অর্ধেক গোটানো। এই অবস্থায় ছাদের পাঁচিল ধরে অবলীলায় পায়চারি করতে দেখতাম তাকে। এছাড়া জলের ট্যাঙ্কের লাগোয়া চিলছাদের ওপর উঠে ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি বহু পিলে-চমকানো কীর্তি দেখেছি তার, হাবে ভাবে নির্বিকার।

চারতলা ফ্ল্যাটের বাড়তি সুবিধে হল ছাদ। আর এটা ছিল টানা দুটো ব্লক জোড়া ছাদ। মাঝখানের বড় জায়গাটায় একটু সাবধানে ক্রিকেট খেলাও সম্ভব ছিল, তবে বল পাঁচিল টপকে নিচে পড়লে আনতে দৌড়তে হতো। আর এই ছাদ ছিল সে যুগের সোশ্যাল নেটওয়ারকিং প্ল্যাটফর্ম। বিকেল থেকে মাঝরাত অবধি, বিভিন্ন সময়ে নানারকমের আলোচনা চলতো, কখনো এই ছাদ আর ওই ছাদের মধ্যেও। সেটা ছিল লোডশেডিঙের যুগ, তাই প্রায় সন্ধ্যেতেই অন্ধকার, আলো আসতে আসতে সেই রাত দুপুর। গরমকালে ছাদে বিছানা পেতে শোয়া এক অবশ্য কর্তব্য ছিল। তোশক বালিশ গোছানোই থাকতো, রাতের খাওয়া মিটলেই দিদার উদ্যোগে সেই বিছানা পোঁছে যেত ছাদে। পাশের ব্লক থেকে উঠে আসতেন প্রতিবেশীরাও, জমাটি আড্ডা শুরু হতো।

সন্ধ্যে নামার জন্যে একরকম মুখিয়ে থাকতাম। তার কারন আমি মামার বাড়িতে এলে বা থাকলে যেটা অবশ্যই হতো সেটা হল এই সন্ধ্যেবেলায় এক জম্পেশ পেটপুজো। আমার বড়মামার ছবি তোলার শখ। আমার ছেলেবেলার বেশ কিছু ছবি মামার বাড়িতে তোলা। তার মধ্যে একটাতে আমি মেঝেতে বসে আর আমার সামনে একটা বড় থালায় দুটো বড় রাধাবল্লভি, আমি তার থেকে একটা অর্ধেক ছিঁড়ে মুখে পুরে এক অপার্থিব আনন্দে গোলগোল চোখে তাকিয়ে। এই ছবি অবশ্য বহুদিন পরে তুললেও একই রকম আসতো। সুকিয়া স্ট্রীটের মুখে আদি অকৃত্রিম নন্দলাল ঘোষের মিষ্টির দোকান, সেখানে বিকেল হলেই রাধাবল্লভি আর ছোলার ডালের সমঝদারদের ভিড় বাড়তে থাকে। একটু এগিয়ে এ-ডি কেবিন, তার পাশ দিয়ে গেলে ফিশ ফ্রাই-এর প্রাণকাড়া গন্ধে নিজেকে সামলে রাখা দায়। তার উল্টোদিকে বহু পুরনো তেলেভাজার দোকান গীতিকা, সেখানে ঢালাও কারবার মোচা আলু ইত্যাদি চপের আর গরম বেগুনি ফুলুরির। আমার জন্যে, বিশেষ ভাবে আমারই জন্যে এইসব অপার্থিব খাদ্যবস্তুর আগমন ঘটতো বৈকালিক বা সান্ধ্যকালীন জলযোগে।

আমার দাদু ছিলেন সে যুগের সিভিল সার্ভেয়ার, শুনেছি এই সিআইটি বিল্ডিংএর ল্যান্ড সার্ভে দাদুর হাতেই করা। আমি যখন দেখেছি তখন তিনি অবসরপ্রাপ্ত তো বটেই, এবং বেশ বয়স্ক। বাইরের ঘরটায় একটা বড় খাট ছিল, তাতে বসতেন দাদু। পাশে বিড়ির কৌটো। দাদুর বন্ধুস্থানীয় ব্রতীনবাবু আসতেন মাঝে মধ্যে গল্পগাছা করতে, আরও আসতেন মায়ের মেসোমশাই আর মামারা। বয়স্কদের আড্ডা জমে উঠতো যখন ওই ঘরে, ওই খাটের ওপর বসেই, তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো শঙ্করদা। একাগ্রভাবে, যে কোন ফরমাস খাটার জন্য প্রস্তুত।

শঙ্করদা মামার বাড়িতেই থাকতো। কতদিন, তা জানিনা। শ্যামলা রঙ গায়ের, দোহারা চেহারা, কিন্তু ভারী শান্ত একটা হাসি ছিল শঙ্করদার। ছোটবেলায় আমি একটু ষণ্ডা গোছের ছিলাম, জানিনা কেন এক বদঅভ্যেস ছিল কিছু নিরীহ লোকের ওপর নিজের শক্তিপরীক্ষা করার। প্রচুর অত্যাচার করেছি কিছু মানুষের ওপর, সেই লিস্টে প্রথম দিকে যেমন আমার রাঙাপিসি, রাঙাকাকু, ঠিক তেমনই শঙ্করদা। আমি আর আমার মাসতুতো ভাই আপ্পু যখন একসাথে মামার বাড়িতে ল্যান্ড করতাম, তখন অঘোষিত এমারজেন্সি জারী হতো। আর তখন এই দুই মূর্তিমান কে সামলানোর দায়িত্ব বর্তাত শঙ্করদার ওপর। খুব আবছা মনে পড়ে, কোথাও একটা ছোট্ট পার্ক ছিল, রেলিং ঘেরা, একফালি ঘাসজমি সমেত। হয়তো গড়পাড়ের দিকটাতে। সেখানে শঙ্করদার সাথে গেছি মনে আছে। পড়ে বড় হয়ে অনেক খুঁজেছি ওই পার্কটাকে, কিন্তু পাইনি। কোন অজানা টাইমজোনে হয়তো আটকে আছে সেই পার্কটা, আমার ছেলেবেলার টুকরো স্মৃতির সাথে, কিছু হারিয়ে যাওয়া মুখ সঙ্গে নিয়ে।

কালের নিয়ম মেনে একদিন শঙ্করদাও চলে গেল মামার বাড়ি ছেড়ে। কিন্তু তার সঙ্গে আমার দেখাশোনা চলেছিল তার পরেও। আমাদের বাড়িতে আসতো মাঝে মাঝে, দেখা করতে। একবার এসে বললো, নিজের ব্যাবসা শুরু করেছে। তখন সল্টলেকে সরকারি দপ্তরগুলো সবে স্থাপিত হতে শুরু করেছে, সেই সময় – কোন এক অফিসে – ক্যান্টিন চালাচ্ছে শঙ্করদা। আমাকে নিয়ে যাবে সেই ক্যান্টিন দেখাতে। আমি প্রবল উৎসাহে জানতে চেয়েছিলাম সেখানে কি কি খাবার পাওয়া যায়। শঙ্করদা ততধিক উৎসাহে আউড়ে গেছিল আমার পরম প্রিয় সব খাদ্যবস্তুর নাম – কাটলেট, ফিশ ফ্রাই, কচুরি, শিঙারা, মোগলাই পরটা ইত্যাদি। আমি পেটুক তো ছিলামই, আর খাওয়ার এমন সুযোগ কে ছাড়ে, ঝুলে পড়লাম শঙ্করদার সাথে। একদিন বৃহস্পতিবার দেখে (স্কুল ছুটি থাকতো ওইদিন) শঙ্করদা আমায় নিয়ে গেল ওর ক্যান্টিন দেখাতে। তখনকার সল্টলেক এতো সহজগম্য ছিল না, বাস রিকশার যুগলবন্দীর সাহায্যে শেষমেশ পৌঁছনো গেল দুপুরের মধ্যে সেখানে। মনে আছে পরম মমতায়, যত্ন করে প্রচুর খাইয়েছিল শঙ্করদা। পয়সা দেওয়ার প্রশ্নই ছিল না, কিন্তু আজ ভাবলে কোথাও একটা কাঁটা খচখচ করে – আমি তখন আর অত ছোট নই, ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি, কিন্তু আমার বোধই ছিল না যে শঙ্করদাকে অন্তত একবার মন থেকে বলি যে কত আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন।

তারপর আর মনে নেই সেভাবে কোনোদিন সেকথা বলার সুযোগ হয়েছিল কি না। বোধহয় না, কারন তারপর নিশ্চয়ই সে তার জীবনযাত্রার চাপে আর পেছনে তাকানোর সুযোগ পায়নি। আমিও আস্তে আস্তে ভুলে যেতে থাকি সেই চেনা মুখ আর চেনা হাসি। আজ মাঝে মধ্যে মনে পড়ে যায় সে সবকিছু।

টাইম মেশিন যদি কেউ পাও, আমাকে জানাবে একবার?  

– ক্রমশ –

One comment

  1. ভানুকে মনে ধরেছে ; আমাদের সন্তোষপুরে এমন একজন ভানু থাকলে বড় সুবিধা হতো .. আর শঙ্করদার ক্যান্টিন দীর্ঘজীবী হোক ..

    Liked by 1 person

Leave a comment