তিন-ইয়ারি কথা (১)

Posted by

এই গল্পটা তিন বন্ধুকে নিয়ে। এক সময়ের অভিন্নহৃদয়ের বন্ধু। তখন তারা ছিল একই পথের পথিক। সময়ের স্রোতের সাথে ভেসে তারা আপাত বিচ্ছিন্ন, আকণ্ঠ নিমজ্জিত দৈনন্দিন জীবনযাপনের বাঁধা অভ্যাসে। কিন্তু তারটা সম্পূর্ণ ছিঁড়ে যায়নি এখনও। মাঝে মাঝে তাতে টান পড়লে টালমাটাল লাগে। আজো কোনো মায়াবী সন্ধ্যায় বেজে ওঠে করুন ভায়োলিন, সৃষ্টি হয় ইন্দ্রজাল, অদৃশ্য স্মৃতিরা দৃশ্যমান হয়।

এরকম অনেক গল্প আছে, থাকবে। চারটে বছর একসাথে কাটানো কম কথা নয়। ধরা যাক এই বন্ধুরা হল রামু, শ্যামু আর যদু (এই লেখাটা সমকালের অন্য কোনো বন্ধু যদি পড়ে, তাহলে সে এই নামগুলোর আড়ালে থাকা মুখগুলো চিনতে পারে কিনা দেখা যাক) – এদের তিনজনকে নিয়ে এই গল্প কখনো বাস্তব কখনো কল্পনার মধ্যে বিচরণ করে।

পর্ব- ১

কোনো এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যেকালে, লর্ডসএর মাঠে ফাঁকা প্যাভিলিয়নের এক কোনায় বসে এই কাহিনীর প্রথম দুছত্র লেখা হয় তাও আবার নিছক আড্ডার ফাঁকেই

সাল ১৯৯২। কোল্ড ওয়ার শেষ হল এই সেদিন, ইয়েলতসিন আর বুশ হাত মিলিয়েছেন। ইউরোপ-এর মানচিত্র পাল্টাচ্ছে, বসনিয়া স্লোভেনিয়া ক্রোয়েশিয়া ইউক্রেইন মাথা তুলছে। দেশে অবশ্য তখনো বিশেষ কোনো খবর নেই, তবে মেঘ একটা জমছে ঈশান কোনে – বছর শেষে বাবরি মসজিদের মাথার ওপর নেমে আসা অকস্মাৎ বজ্রপাতের আভাস আবহাওয়া দপ্তর সময়মতো দিতে পেরেছিলেন কিনা সেটা তর্কের বিষয়। আর তার সাথে ভারতীয় মুদ্রার বিদেশি ডলারের কাছে মাথা হেঁট করার সেই শুরু। তবে এপ্রিলের সেই সন্ধ্যেয় সেই তিনমূর্তির এসবে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তারা বহাল তবিয়তে ছিল। ভয় ছিল একটাই। সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা একেবারে দোরগোড়ায়।

যদি কলেজের সব থেকে ভুলভাল কোনো বছরকে বেছে নিতে হয়, মানে পড়াশোনার নিরিখে, তাহলে সেটা অবধারিত এই বছরটা। রামু হাফ-ইয়ারলিতে অঙ্কে একশোয় তেরো পেয়েছিল, আরেকটা ডিপার্টমেনটাল সাবজেক্ট-এ আট। নোটিস বোর্ড-এ টাঙ্গানো নেম-লিস্ট-এ নামের পাশে এই সব নম্বর দেখে নিজেই তাজ্জব হয়ে গেছিল – শেষে ক্যান্টিনের কড়া এক কাপ চায়ে ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কেটে সম্বিত ফেরে। এরকম চললে ফাইনাল-এ পাশ করবে কিনা ঘোর সন্দেহ। তা বলে ব্রিজ খেলায় কমতি নেই। ক্লাস গুলি মেরে তাস। খাটের পাশে দেওয়ালটাতে কালো আর্ট পেপার সেঁটে জুহি চাওলার পোস্টার, পাশে জামা খোলা স্ট্যালোন। তার ভক্তেরও জামার বুকের বোতামটা খুলেই ঘোরাঘুরি, তবে দেখেও কেউ খুব একটা দেখে না। তাতে দমে যায় নি, তবুও জগাই লড়ে যায়।

ওদিকে শ্যামু সিরিয়াস গোছের। বরাবরই একটু শৌখিন-ও। তাই নিয়ম করে ক্লাস করার সাথে সাথে (‘আশিকি’ খ্যাত) রাহুল রয় মার্কা চুলটার বেশ যত্ন নেওয়াও চলে। রামুর রুমমেট, তাই দুজনে মিলে সিগারেট-টা কাউনটার করেই খায়। ইদানিং মাঝে মধ্যে লেডিস হোস্টেলের দিকটায় তাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে, নোটস আনার অছিলায়। হাফ-ইয়ারলিতে রামুর মতো না হলেও কানের পাশ দিয়ে কয়েকটা সাবজেক্ট বেরিয়ে গেছে। প্রতি শুক্রবারে ক্লাস শেষ হলে বি-গার্ডেন-ধর্মতলা মিনি ধরে বাড়ি ফেরা চাই অবশ্যই, আর এরকমই এক সপ্তাহান্তে – হয়তো ওই কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া সাবজেক্ট গুলোর বদান্যতায় – শ্যামুর বাবার নজর পড়ে ওই চুলে। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হোক, রাহুল রয় নয়। তাই ফের সোমবার সকালে ছেলে হোস্টেলে ফেরে ব্যাক-টু-বাংলায়, মানে আর কি চুল-টুল সব কেটে।

আর যদু সত্যিই যদু, ঘি-মাখন খাওয়া শরীর। খেতে অসম্ভব ভালোবাসে, আর ওর বরাদ্দ খাবারটা কেউ মেরে দিলে রেগে কাঁই। শোনা যায় একবার পেট খারাপ চলাকালীন ক্লাস করতে গিয়ে এক জাঁদরেল প্রফেসরকে জিগ্যেস করেছিলো এই অবস্থায় শুকনো মুড়ি খাওয়া যায় কিনা। আর এই গোপন তথ্যটা হোস্টেলে ফাঁস করে দিয়েছিল শ্যামু, ওর স্বভাবসিদ্ধ খিক-খিক হাসি সহযোগে। বিকেলের দিকে কলেজ গেটের বাইরে তরুণদার দোকানে মোগলাই পরোটা বা চাউমিন-এর নিয়মিত সমঝদার।  তবে হালফিল এই ফাইনাল পরীক্ষার চাপে একটু বেসামাল। তাই সান্ধ্য ভাটের আড্ডাগুলোতে বেশ চিন্তিত দেখায় তাকে। সিগারেটটা একটু বেশিই খাওয়া হচ্ছিলো, তাই খরচ বাঁচাতে নেমে আসা কলেজ বিড়িতে। একবার ভেবেছিল শ্যামুর মতো সেও লেডিস হোস্টেলের নোটস আনার একটা প্রচেষ্টা নেবে, কিন্তু শেষমেশ অনেক ভেবে নিজেকে বিরত রাখাই শ্রেয় মনে করে।

এদের তিনজনেরই – মাসে একআধবার– এক সর্বজনীন সান্ধ্যকালীন গন্তব্যস্থল ছিল, সেটা হল লর্ডস-এর দোতলার প্যাভিলিয়ন।

একজন ঢলঢলে হাফপ্যান্ট পরিহিত, বগলে একটি পেটমোটা বেঁটেখাটো বোতল, হাতে একটা ঠোঙা – তাতে আদাকুচি আর বাদাম – পকেটে কলেজ বিড়ির বান্ডিল। আরেকজন ফিটফাট, যেমন সবসময় থাকে, হাল্কা রঙের টি–শার্ট-জিন্স, হাতে একটি টেপ-রেকর্ডার আর পকেটে কয়েকটা ক্যাসেট। তিন নম্বরের আবার সন্ধেবেলায় একটু পাঞ্জাবি-পাজামা না হলে চলে না – জমিদারি মেজাজটা যাবে কোথায় – আর হাতে একটা স্টিলের জলের জাগ, তিনটে গেলাস (মেস থেকে ঝেড়ে আনা)।  শেষ বিকেলের কোলাহলটা যেই পড়ে এসেছে, ফার্স্ট-গেট ফেরত জনতা যে যার ঘরে ফিরে ব্যস্ত নিজেদের একটু গুছিয়ে নিতে, অতি সিরিয়াস কেউ সবে বই খুলে বসেছে, একটি বিশেষ গোষ্ঠী তাদের দৈনন্দিন সন্ধিপুজোর তোড়জোড় শুরু করেছে, দোতলার কমন রুমে টেলিভিশন সেটের সামনে আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে – ঠিক তখনই এই তিনমূর্তি চুপিচুপি সটকে হোস্টেলের বাইরে পাতলা রাস্তাটা দিয়ে লর্ডস-এর দিকে ধাবমান। কিছুক্ষন আগের জমজমাট লর্ডস মাঠ তখন শুনশান ফাঁকা, বাঁদিকে কলেজ বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো, ডানদিক থেকে আবছা ভেসে আসছে রিচ বা ম্যাক-এর অস্পষ্ট কোনো কণ্ঠস্বর।

এপ্রিলের গোড়ার দিকের সেই সন্ধ্যায়, এরকমই এক ঠেক। দ্রুত পায়ে মাঠটা পেরিয়ে প্যাভিলিয়নের দোতলার এক কোনে গুছিয়ে বসেছে ছায়ামূর্তিরা। হালকা করে ব্যাকগ্রাউণ্ডে টেপ-রেকর্ডারে বাজছে ক্লিফ রিচার্ড-এর সামার হলিডে। শ্যামু একটু উদাস, রামু আলতো করে ঠোঁট মেলাচ্ছে গানের সঙ্গে, ক্লিফ রিচার্ড তাদের দুজনেরই পছন্দের। যদু অন্যমনস্ক ভাবে তার পুরুষ্টু গোঁফে তা দিচ্ছে। ক্রমশ এগিয়ে আসা ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে আর ভালো লাগছে না, বরং তারপর কি করা যায় ওই লম্বা একমাসের ছুটিটায়, সেই কাল্পনিক চিন্তাটা অনেক বেশী আকর্ষণীয়। প্রথম এক সপ্তাহ তো কেটেই যাবে ঘুমিয়ে, এক চিলতে হাসি নিয়ে জানান দেয় রামু। পাড়ার বন্ধুদের সাথে রকে বসে আড্ডা চলবে, বিকেলে ফুটবল। এছাড়া নিউ মার্কেট চত্বরে যেতে হবে বারকয়েক, লাইটহাউস নিউ এম্পায়ার-এ নতুন কি সিনেমা এলো তা দেখতে হবে বইকি। যদু গুছিয়ে খাবে বাড়ি বসে। বাদাম আর আদাকুচি চিবোনোর ফাঁকে বেদুইনের চিকেন রোলের ভেসে আসা স্মৃতি মন খারাপ করে দেয়। লেকের ধারে পুরনো ঠেকে হাজিরা দিতে হবে অবশ্যই। আর তৃতীয় ব্যাক্তিটি ঝেড়ে কাশছে না, তার কি অন্যরকম কোনো প্ল্যান আছে? শোনা যায় পাড়ার এক বান্ধবীর তার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা। তবে কি এইবার উইকেট পড়বে?

সামার হলিডে শেষ, ঝটকা দিয়ে থেমে গেল রেকর্ডার। কোথাও ঘুরতে গেলে কেমন হয়? হালকা আড়ামোড়া ভেঙে আনমনা ভাবটা ঝেড়ে ফেলে প্রস্তাবটা হঠাৎই দিয়ে ওঠে শ্যামু।

মানে? পিকনিক, নাকি নাইট হল্ট?

আরে না, ধর এই হপ্তাখানেকের ছোট একটা ট্রিপ, কাছাকাছি কোথাও।

তার আগে ফাইনালটা দিতে হবে তো, পরে ভাব ওসব। সাপ (সাপ্লিমেন্টারী) নেমে গেলে গরমের ছুটি ভোগে চলে যাবে। তুই নোটস গুলো দিলি না, এত করে বললাম।

দেবো, ঠিক টাইমে। তুই এই ফাঁকে কিছু চোথা বানিয়ে ফেল। ওগুলো বেশি কাজে লাগবে।   

আপাতত তুই ক্যাসেটটা উল্টে দে, ডান্সিং শু’স টা শুনি, মুডটা বরবাদ করিস না।  

গ্লাসের অবশিষ্ট তরল পদার্থ এক ঢোকে গলাধঃকরণ করে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে তিনমূর্তি। দুরে হোস্টেল ১৪ আর সেন হলের অবয়ব ক্রমশ ফিকে হতে থাকে। ক্লিফ রিচার্ড গেয়ে চলেন, আর গ্যাল্যারির কংক্রিটের ধাপে গা এলিয়ে আকাশ দেখে তাঁর শ্রোতারা। কলেজ ক্যাম্পাসটা এসময় নিঝুম আর শান্ত হয়ে যায়, আর আকাশটা সীমাহীন। তারাদের ঝিকমিক আর স্তব্ধতায় মিলিয়ে যাওয়া সুরে সৃষ্টি হয় মায়াবী এক কল্পলোক। জ্বলতে থাকা সিগারেটের টুকরোগুলো আঙুলের ফাঁকে ছোট হতে থাকে। আধবোঁজা চোখে ঝাপসা হতে থাকে স্বপ্নরা।

আচম্বিতে কোনো আধাচেনা কণ্ঠস্বরে সম্বিত ফিরে আসে। রাতের আঁধারে মুচিপাড়া থেকে ফিরছে কিছু জনতা, লর্ডস-এর বুক চিরে পায়ে চলা ঘাসপথটা ধরে। ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে রামু বলে ওঠে –

চল তবে, ঘুরেই আসি কোথাও।

কোথায়?

এই গরমে চল পাহাড়ে যাই। জমে যাবে। দার্জিলিং।

ও আমার ঘোরা। আর পকেটে মালকড়ি নেই অত, বাড়িতে বললে ঝাড় খাবো। ফাইনালে ছড়ালে তো কথাই নেই। আমার কেস একটু জন্ডিস আছে। ওসব হবে না।

মালকড়ি কি আমার আছে নাকি? মা’কে বলে ম্যানেজ করতে হবে। আর যাবি তো ফাইনালের পর, রেসাল্ট বেরোতে অনেক দেরি, এই ফাঁকে ব্যাপারটা নেমে যাবে। তারপর যা আছে কপালে।

খিক খিক করে হেসে ওঠে শ্যামু।

কেস জন্ডিস হলে আর ফেরার দরকার নেই, তুই ওখানেই চাউমিন বেচিস, আমরা মাঝে মধ্যে ফ্রি-তে খেতে যাবো।

ছোট করে একটা অশান্তি হতে যাচ্ছিল, যদু বাছাই করা কিছু শব্দব্রহ্ম উৎক্ষেপণ শুরু করেছিল কিন্তু মাঝপথে রামু নিরস্ত করে ফেলে। কিন্তু খিক খিক হাসিটা সংক্রামক, সেটা তাকেও গ্রাস করে দ্রুত। উপায় যখন নেই, তখন উপেক্ষাই বাঞ্ছনীয়, অগত্যা গম্ভীর হয়ে একটা বিড়ি ধরায় যদু।

একটু পরে আবার কথাটা ওঠে, এইবার আর অতটা নিমরাজি শোনায় না কাউকেই। তবে এই তিন ল্যাদখোরের দ্বারা অত প্ল্যানিং সম্ভব নয়, তাই ঠিক হয় অমুক দিনে তমুক সময় চলে আসতে হবে ধর্মতলায়। গরমের ছুটিতে আপামর বাঙালীর বেড়ানোর হুজুগে ট্রেনে টিকিট পাওয়া দুস্কর, তাই বাসে যাওয়া যাক এন-জে-পি।

বাকি ভগওয়ান ভরোসা, যা হয় দেখা যাবে।

অনেক রাতে, যখন সাহেবপাড়া গভীর ঘুমে ডুবে, নিস্তব্ধতা সঙ্গী করে ঘরে ফেরে রাত জাগা নিশাচরেরা। চোখে ঘুম নেমে আসার আগে স্বপ্ন আসে; পাহাড়ি পথ দিয়ে সারারাত আঁকাবাঁকা চলে বাস দাঁড়িয়েছে ভোরের কোনো সদ্য খোলা চায়ের দোকানে, ধোঁয়া ওঠা চায়ের গেলাস হাতে নিয়ে দূরে কুয়াশায় ভিজে যাওয়া সবুজ দেখছে ঘুমভাঙা টুরিস্ট, আর দোকানের রেডিও থেকে ভেসে আসছে কিশোর কুমারের ‘ও হন্সিনি’।

 – ক্রমশ

One comment

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s