পর্ব- ১
বেশ কিছু মুখ ভেসে ওঠে, আধো ঘুমে। তাদের দেখি বহু যুগ পর, এতদিন ছিল অবচেতনে, কিন্তু ছিল। মনের ভেতর কোথায় কি থাকে বলা যায় না। ঘুমের মধ্যে তারা যখন আসে, তখন একরাশ স্মৃতি মন্থিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভেজা ফুলের মত। সুগন্ধে ভরে ওঠে স্বপ্নরা। আমি আমার এই মাঝবয়েসের বিপন্নতার মধ্যেও সেই সুগন্ধ নিই মন ভরে।
এই সব মুখ এক এক চরিত্র। পার্শ্বচরিত্রই বলা যায়। অনেকদিনের অদেখায় এরা বাস্তবের ভিড় থেকে ক্রমশ সরে গিয়ে রয়ে গেছে এক মায়াবী জগতে। কিন্তু এরা কেউ কাল্পনিক নয়। আমার ফেলে আসা ছেলেবেলায় আজো তারা আছে। আছে বলেই তারা আজো আসে, আমার আধো ঘুমে।
.. পিসী ..
আমি যখন খুবই ছোট, দু তিন বছর বয়েস হবে হয়তো, সেই সময় মনে পড়ে আমাদের বাড়িতে – আমাদের বেলগাছিয়া ভিলার একতলার দুকামরার ফ্লাটবাড়িতে – অনেকে মিলে থাকা হত। আরো অনেকের রোজকার আনাগোনা লেগেই থাকতো সেখানে, প্রায় প্রতিদিনই। ভেতরের ঘরে থাকতাম বাবা মা আর আমি। থাকতাম বলা ভুল, বলা উচিত রাতে ঘুমোতাম। দিনের বেশির ভাগ সময় আমি থাকতাম বাইরের ঘরটায়, যেটাতে আমার আম্মার জন্য পাতা ছিল একটা বড় চৌকি। চৌকিটা ছিল জানলার ঠিক পাশে। আমি চৌকির ওপর উঠে বেয়ে উঠতাম জানলার সামনে গাঁথনিটায়, যেখানে বসে জানলার গরাদে মুখ রেখে বাইরের লোকজন দেখে সময় কাটত আমার। আম্মা আমাকে ওই জানলার বসিয়েই খাইয়ে দিত – সকালের ডিমসেদ্ধ, কমলা লেবুর রস, দুপুরের মাছের ঝোল ভাত। ডিম সেদ্ধ মুখে নিয়ে আমি মুখ মুছতাম আম্মার মুখেই, কখনো আম্মার ধবধবে সাদা কাপড়ে। আমার আম্মা তাতে আরও বেশি করে মুখে গুঁজে দিত খাবার, আর পরম মমতায় মুছিয়ে দিত আমার মুখ, আমার গাল নিজের ওই ধবধবে সাদা কাপড় দিয়ে।
ওই চৌকিটার সঙ্গে বহুদিনের যোগ ছিল আমার, ওই ঘরটার সঙ্গেও। আর আম্মা ছিল ওই ঘরের ভার-কেন্দ্র। ওই ঘরেতেই কিছু বছর পর বাবার জন্যে বসেছিল ছোটখাটো একটা হাসপাতাল, প্রায় ছমাস (হয়তো আরও বেশি) প্রাণপণ চেষ্টা করেও বাবাকে ধরে রাখা যায়নি। এক ভোরে ওই ঘর থেকেই বাবার শেষ যাত্রা শুরু হয় এক অজানা গন্তব্যের অভিমুখে। আম্মা সেদিনও ছিল সে ঘরে, তার অত্যধিক প্রিয় বড় ছেলেকে বিদায় জানাতে। দিশাহারা সেদিন মৃতপ্রায়, অত লোকের ভিড়ে হারিয়ে গিয়ে ভাষাহীন। আর তারপর, যেন বেঁচে থাকার তাগিদেই, আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিল আমার ছোট ভাইকে আর আমাকে। ঘরটা সাক্ষী সেসব বাঁচার লড়াইয়ের। আমার ক্লাস টেন-এর ফাইনাল পরীক্ষার সময় – আমি তার আগে থেকেই ওই ঘরের বাসিন্দা হয়ে গেছি – আমি রাত জেগে পড়তাম। আম্মা ঠিক ভোর-রাতে উঠতো পুজো করতে, কিন্তু ঘরের আলো জ্বালাতো না পাছে আমার ক্লান্ত ঘুম ভেঙে যায়। নিজের ছোট্ট পুজোর তাকে ছোট আলো জ্বালিয়ে প্রায় নিঃশব্দে পুজো সেরে ফেলতো। আর তারপর, একটু সকালের আলো ফুটলে, আস্তে আস্তে আমায় ঘুম থেকে তুলতো। স্নিগ্ধ ধুপের গন্ধ ভাসতো বাতাসে, আমি চৌকির ওপর আধশোয়া হয়ে বই খুলতাম।
যার কথা বলবো ভাবলাম, তার কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল আম্মার কথা। পড়লো কারন সেও ছিল আম্মার মতই। অনেকটা আম্মার ছায়াসঙ্গী। অন্তত আমার স্মৃতিতে। সেই ছোটবেলায়, আবছা মনে পড়ে, আমাদের বাড়িতে থাকতো সে, আমি পিসী বলে ডাকতাম। খুব সম্ভবত রান্নাবান্নার দিকটা দেখত পিসী। সন্ধেবেলায়, আমাদের রান্নাঘর সংলগ্ন খাবার ঘরের মেঝেতে বসে পিসী আটা মাখছে, আর আমি গিয়ে তার কোলে বসছি। তার সাদা থান, মাথা ঢাকা ঘোমটা, চোখে কালো ফ্রেমের মোটা চশমা, কিন্তু একগাল ফোকলা হাসি। রোগাভোগা বেঁটেখাটো চেহারা, আম্মারই বয়সী। আমার দামালপনা সামলাতে কষ্টই হত নিশ্চয়ই। হলেও বুঝিনি, বোঝার বয়সও ছিল না সেটা। পিসীর কোলে বসলে একটা অদ্ভুত অনুভুতি হত, আজো মনে পড়ে। উষ্ণ, আরামদায়ক একটা অনুভুতি, একটা সোঁদা গন্ধ, ঘুমপাড়ানী কোনও সুর, কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া আপনমনে।
আম্মা ডাকতো সরোজিনী। তার রেশন কার্ডও ছিল আমাদের কাছে, অনেকদিন অবধি, পিসী চলে যাওয়ার পরেও। আরেকজন তাকে ডাকতো নাম ধরে। আমাদের বাড়িতে একট টিয়াপাখি ছিল, সে ডাক দিত সরোজিনী বলে। এই টিয়াটাও আমার ছেলেবেলার আরেক সঙ্গী, বহুদিন বেঁচে ছিল, এক-আধবার খাঁচা থেকে পালিয়ে উড়ে গিয়েও ফিরে এসেছিল।
পিসী আমাদের বাড়ির লোক নয়, একজন বাইরের মানুষ, এই ব্যাপারটা বোধগম্য হয়নি। দিনগুলো তখন অন্যরকম ছিল। সামাজিক ব্যবধান মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ করতে শেখায়নি তখনও। তাই প্রায়ই ভাবতাম, পিসী কোথায় চলে গেল হঠাৎ? তার ঠিকানা ছিল কি? কেন গেল?
আবছা মনে পড়ে, সন্ধেবেলায় আমাদের বাড়িতে অনেক লোকের সমাগম। আমার ছোটকাকু, যাকে আজো কাকু বলে ডাকি, আর আমার বড় হয়ে যাওয়া ছেলে বলে গল্পদাদু, এক অসাধারন বৈঠকি মানুষ। তাকে ঘিরে আমার আরও অনেক কাকা পিসীরা বসে চৌকিতে, কাকু গল্প বলছে। বাবা একটু আলাদা একটা চেয়ারে বসে মুচকি হাসছে। আম্মা একটা বড় বাটিতে সর্ষের তেল আর চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখছে সবার জন্যে। মা ব্যস্ত হয়ে একবার রান্নাঘর একবার বাইরের ঘর করছে। আর পিসী সবাইকে চা-এর কাপ হাতে হাতে দিয়ে যাচ্ছে। আর আমি উড়ে বেড়াচ্ছি একবার এই কোল থেকে সেই কোলে।
ঘুমের ঘোরে আজো সেই সোঁদা গন্ধ আসে। সেই কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে ছানিপড়া আধবোঁজা চোখদুটো হাসি ছড়ায়। তার কোলে মাথা রেখে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি। ভাঙা ঘুম কখন জোড়া লাগে আবার, জানি না।
– পরবর্তী পর্ব –